৭৬.সূরা দাহর سورة الدَّهْرِ Surah Dahr এর তাফসীর ও শানে নুযুল

সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর আয়াত ৮,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর এর ফজিলত, surah dahr,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর এর ফজিলত,সূরা আদ-দাহর বাংলা অনুবাদ,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর আয়াত ১৫,surah a dukhan,সূরা আদ দাহর,সূরা দাহার, দাহর অর্থ কি, সূরা দাহর এর শানে নুযুল, সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা আদ দাহর,সূরা আদ-দাহর বাংলা অনুবাদ,সূরা দাহর,فوائد سورة الدَّهْرِ,
সূরা দাহর এর শানে নুযুল

সূরা দাহর এর পরিচয় :

সূরার নাম : সূরা দাহর/সূরা ইনসান।সূরার অর্থ : মানুষ।
সূরা নং : ৭৬রুকু : ২
আয়াত সংখ্যা : ৩১সিজদা : ০
শ্রেণী : মাদানী।পারার সংখ্যা : ২৯

সূরা দাহর سورة الدَّهْرِ Surah Dahr এর তাফসীর ও শানে নুযুল


بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

শুরু করছি আল্লাহ তা’আলার নামে, যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

هَلْ أَتَىٰ عَلَى الْإِنسَانِ حِينٌ مِّنَ الدَّهْرِ لَمْ يَكُن شَيْئًا مَّذْكُورًا -(١)

(১) মানুষের ওপরে কি অন্তহীন মহাকালের এমন একটি সময়ও অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কোনো জিনিসই ছিল না ?

إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا -(٢)

(২) আমি মানুষকে এক সংমিশ্রিত বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি। যাতে তার পরীক্ষা নিতে পারি। এ উদ্দেশ্যে আমি তাকে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি।

(٣)- إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا

(৩) আমি তাকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি। এরপর হয় সে শোকর গোযার হবে নয়তো হবে কুফরের পথ অনুসরণকারী।

(٤)- إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ سَلَاسِلَ وَأَغْلَالًا وَسَعِيرًا

(৪) আমি কাফেরদের জন্য শিকল, বেড়ি এবং জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি।

(٥)- إِنَّ الْأَبْرَارَ يَشْرَبُونَ مِن كَأْسٍ كَانَ مِزَاجُهَا كَافُورًا

(৫) (জান্নাতে) নেক্কার লোকেরা পানপাত্র থেকে এমন শরাব পান করবে যাতে কর্পূর পানি সংমিশ্রিত থাকবে।

(٦)- عَيْنًا يَشْرَبُ بِهَا عِبَادُ اللَّهِ يُفَجِّرُونَهَا تَفْجِيرًا

(৬) এটি হবে একটি বহমান ঝর্ণা, আল্লাহর বান্দারা” যার পানির সাথে শরাব মিশিয়ে পান করবে এবং যেখানেই ইচ্ছা সহজেই তার শাখা-প্রশাখা বের করে নেবে।

(٧)- يُوفُونَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُونَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيرًا

(৭) এরা হবে সেসব লোক যারা (দুনিয়াতে) মানত পূরণ করে সে দিনকে ভয় করে যার বিপদ সবখানে ছড়িয়ে থাকবে।

(٨)- وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا

(৮) আর আল্লাহর মহব্বতে” মিসকীন, ইয়াতীম এবং বন্দীকে খাবার দান করে

(٩)- إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا

(৯) এবং(তাদেরকে বলে,) আমরা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই তোমাদের খেতে দিচ্ছি। আমরা তোমাদের কাছে এর কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা পেতে চাই না।

(١٠)- إِنَّا نَخَافُ مِن رَّبِّنَا يَوْمًا عَبُوسًا قَمْطَرِيرًا

(১০) আমরা তো আমাদের রবের পক্ষ থেকে সেদিনের আযাবের ভয়ে ভীত, যা হবে কঠিন বিপদ ভরা অতিশয় দীর্ঘ দিন।

(١١)- فَوَقَاهُمُ اللَّهُ شَرَّ ذَٰلِكَ الْيَوْمِ وَلَقَّاهُمْ نَضْرَةً وَسُرُورًا

(১১) আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সেদিনের অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে সজীবতা ও আনন্দ দান করবেন।

(١٢)- وَجَزَاهُم بِمَا صَبَرُوا جَنَّةً وَحَرِيرًا

(১২) আর তাদের সবরের বিনিময়ে তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী পোশাক দান করবেন।

(١٣)- مُّتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ ۖ لَا يَرَوْنَ فِيهَا شَمْسًا وَلَا زَمْهَرِيرًا

(১৩) তারা সেখানে উচুঁ আসনের ওপরে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রোদের উত্তাপ কিংবা শীতের তীব্রতা তাদের কষ্ট দেবে না।

(١٤)- وَدَانِيَةً عَلَيْهِمْ ظِلَالُهَا وَذُلِّلَتْ قُطُوفُهَا تَذْلِيلًا

(১৪) জান্নাতের বৃক্ষরাজির ছায়া তাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছায়া দিতে থাকবে। আর তার ফলরাজি সবসময় তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে (তারা যেভাবে ইচ্ছা চয়ন করতে পারবে)।

(١٥)- وَيُطَافُ عَلَيْهِم بِآنِيَةٍ مِّن فِضَّةٍ وَأَكْوَابٍ كَانَتْ قَوَارِيرَا

(১৫) তাদের সামনে রৌপ্য পাত্র ও স্বচ্ছ কাঁচের পাত্রসমূহ পরিবেশিত হতে থাকবে।

(١٦)- قَوَارِيرَ مِن فِضَّةٍ قَدَّرُوهَا تَقْدِيرًا

(১৬) কাঁচ পাত্রও হবে রৌপ্য জাতীয় ধাতুর যা (জান্নাতের ব্যবস্থাপকরা) যথাযথ পরিমাণে পূর্ণ করে রাখবে।

(١٧)- وَيُسْقَوْنَ فِيهَا كَأْسًا كَانَ مِزَاجُهَا زَنجَبِيلً

(১৭) সেখানে তাদের এমন সুরা পাত্র পান করানো হবে যাতে শুকনো আদার সংমিশ্রণ থাকবে।

(١٨)- عَيْنًا فِيهَا تُسَمَّىٰ سَلْسَبِيلً

(১৮) এটি জান্নাতের একটি ঝর্ণা যা ‘সালসাবীল’ নামে অভিহিত।

وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُونَ إِذَا رَأَيْتَهُمْ حَسِبْتَهُمْ لُؤْلُؤًا مَّنثُورًا -(١٩)

(১৯) তাদের সেবার জন্য এমন সব কিশোর বালক সদা তৎপর থাকবে যারা চিরদিনই কিশোর থাকবে। তুমি তাদের দেখলে মনে করবে যেন ছড়ানো ছিটানো মুক্তা।

(٢٠)- وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيمًا وَمُلْكًا كَبِيرًا

(২০) তুমি সেখানে যে দিকেই তাকাবে সেদিকেই শুধু নিয়ামত আর ভোগের উপকরণের সমাহার দেখতে পাবে এবং বিশাল সাম্রাজ্যের সাজ-সরঞ্জাম তোমাদের দৃষ্টিগোচর হবে।

عَالِيَهُمْ ثِيَابُ سُندُسٍ خُضْرٌ وَإِسْتَبْرَقٌ ۖ وَحُلُّوا أَسَاوِرَ مِن فِضَّةٍ وَسَقَاهُمْ رَبُّهُمْ شَرَابًا طَهُورًا -(٢١)

(২১) তাদের পরিধানে থাকবে মিহি রেশমের সবুজ পোশাক এবং মখমল ও সোনালী কিংখাবের বস্ত্র রাজি। আর তাদেরকে রৌপ্যের কঙ্কন পরানো হবে। আর তাদের রব তাদেরকে অতি পবিত্র শরাব পান করাবেন।

(٢٢)- إِنَّ هَـٰذَا كَانَ لَكُمْ جَزَاءً وَكَانَ سَعْيُكُم مَّشْكُورًا

(২২) এ হচ্ছে তোমাদের জন্য প্রতিদান। কারণ, তোমাদের কাজকর্ম মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছে।

(٢٣)- إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ تَنزِيلًا

(২৩) হে নবী! আমিই তোমার ওপরে এ কুরআন অল্প অল্প করে নাযিল করেছি।

(٣٤)- فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعْ مِنْهُمْ آثِمًا أَوْ كَفُورًا

(২৪) তাই তুমি ধৈর্যের সাথে তোমার রবের হুকুম পালন করতে থাকো” এবং এদের মধ্যকার কোনো দুষ্কর্মশীল এবং সত্য অমান্যকারীর কথা শুনবে না।

(٢٥)- وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ بُكْرَةً وَأَصِيلًا

(২৫) সকাল সন্ধ্যায় তোমার রবের নাম স্মরণ করো।

(٢٦)- وَمِنَ اللَّيْلِ فَاسْجُدْ لَهُ وَسَبِّحْهُ لَيْلًا طَوِيلً

(২৬) রাতের বেলায়ও তার সামনে সিজদায় অবনত হও। রাতের দীর্ঘ সময় তাঁর তাসবীহ অর্থাৎ পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকো।

(٢٧)- إِنَّ هَـٰؤُلَاءِ يُحِبُّونَ الْعَاجِلَةَ وَيَذَرُونَ وَرَاءَهُمْ يَوْمًا ثَقِيلً

(২৭) এসব লোক তো দ্রুত লাভ করা যায় এমন জিনিসকে (দুনিয়াকে) ভালবাসে এবং ভবিষ্যতে যে কঠিন দিন আসছে। তাকে উপেক্ষা করে চলছে।

نَّحْنُ خَلَقْنَاهُمْ وَشَدَدْنَا أَسْرَهُمْ ۖ وَإِذَا شِئْنَا بَدَّلْنَا أَمْثَالَهُمْ تَبْدِيلًا -(٢٨)

(২৮) আমিই এদের সৃষ্টি করেছি এবং এদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যক্ষ ও সন্ধিস্থল মজবুত করেছি। আর যখনই চাইবো তাদের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে দেব।

(٢٩)- إِنَّ هَـٰذِهِ تَذْكِرَةٌ ۖ فَمَن شَاءَ اتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِ سَبِيلً

(২৯) এটি একটি উপদেশ বাণী। এখন কেউ চাইলে তার রবের দিকে যাওয়ার পথ অবলম্বন করতে পারে।

(٣٠)- وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا

(৩০) তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না যদি আল্লাহ না চান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সুবিজ্ঞ ।

(٣١)- يُدْخِلُ مَن يَشَاءُ فِي رَحْمَتِهِ ۚ وَالظَّالِمِينَ أَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

(৩১) যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তাঁর রহমতের মধ্যে শামিল করেন। আর জালেমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি।

সূরা দাহর এর নামকরণ

সূরার একটি নাম আদ্ দাহর এবং আরেকটি নাম আল ইনসান। দুটি নামই এর প্রথম আয়াতের هَلْ أَتَىٰ عَلَى الْإِنسَانِ এবং حِينٌ مِّنَ الدَّهْرِ আয়াতাংশ থেকে গৃহীত হয়েছে।

সূরা দাহর নাযিল হওয়ার সময়-কাল

তাফসীরকারদের অধিকাংশই বলেছেন যে, এটি মক্কায় অবতীর্ণ সূরা। আল্লামা যামাখশারী র., ইমাম রাযী, কাজী বায়যাবী, আল্লামা নিজামুদ্দীন নীশাপুরী, হাফেয ইবনে কাসীর এবং আরো অনেক তাফসীরকার এটিকে মক্কী সূরা বলেই উল্লেখ করেছেন। আল্লামা আলুসীর মতে এটিই অধিকাংশ মুফাস্সিরের মত । কিন্তু অপর কিছুসংখ্যক তাফসীরকারের মতে পুরা সূরাটিই মাদানী ।

আবার কারো কারো মতে এটি মক্কী সূরা হলেও এর ৮ থেকে ১০ পর্যন্ত আয়াতগুলো মদীনায় নাযিল হয়েছে। অবশ্য এ সূরার বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভঙ্গি মাদানী সূরাসমূহের বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বরং এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে স্পষ্ট বুঝা যায়, এটি যে মক্কায় অবতীর্ণ শুধু তাই নয়, বরং মক্কী যুগেরও সূরা মুদ্দাস্সিরের প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হওয়ার পর যে পর্যায়টি আসে সে সময় নাযিল হয়েছিল ।

৮ থেকে ১০ (وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ থেকে يَوْمًا عَبُوسًا قَمْطَرِيرًا) পর্যন্ত আয়াতগুলো গোটা সূরার বর্ণনাক্রমের সাথে এমনভাবে গাঁথা যে, যদি কেউ পূর্বাপর মিলিয়ে তা পাঠ করে তাহলে তার মনেই হবে না যে, এর আগের এবং পরের বিষয়বস্তু ১৫-১৬ বছর পূর্বে নাযিল হয়েছিল এবং এর কয়েক বছর পর নাযিল হওয়া এ তিনটি আয়াত এখানে এনে জুড়ে দেয়া হয়েছে।

সূরা দাহর এর বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য

এ সূরার বিষয়বস্তু হলো দুনিয়ায় মানুষকে তার প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করা । তাকে একথা জানিয়ে দেয়া যে, সে যদি তার এ মর্যাদা ও অবস্থানকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে শোকর বা কৃতজ্ঞতামূলক আচরণ করে তাহলে তার পরিণতি কি হবে এবং তা না করে যদি কুফরীর পথ অবলম্বন করে তাহলেই বা কি ধরনের পরিণতির সম্মুখীন হবে। কুরআনের বড় বড় সূরাগুলোতে এ বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু মক্কী যুগের প্রথম পর্যায়ে অবতীর্ণ সূরাগুলোর একটি বিশেষ বর্ণনাভঙ্গি হলো পরবর্তী সময়ে যেসব বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে এ যুগে সে বিষয়গুলোই অতি সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী পন্থায় মন-মগজে গেঁথে দেয়া হয়েছে।

এজন্য সুন্দর ও ছোট ছোট এমন বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে যা আপনা আপনি শ্রোতার মুখস্ত হয়ে যায় এতে সর্বপ্রথম মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এক সময় এমন ছিল, যখন সে কিছুই ছিল না। তারপর সংমিশ্রিত বীর্য দ্বারা এত সূক্ষ্মভাবে তার সৃষ্টির সূচনা করা হয়েছে যে, তার মা পর্যন্তও বুঝতে পারেনি যে, তার অস্তিত্বের সূচনা হয়েছে। অন্য কেউও তার এ অণুবীক্ষণিক সত্তা দেখে একথা বলতে সক্ষম ছিল না যে, এটাও আবার কোনো মানুষ, যে পরবর্তী সময়ে এ পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা হিসেবে গণ্য হবে। এরপর মানুষকে এ বলে সাবধান করা হয়েছে যে, এভাবে তোমাকে সৃষ্টি করে এ পর্যায়ে তোমাকে পৌঁছানোর কারণ হলো তোমাকে দুনিয়াতে রেখে আমি পরীক্ষা করতে চাই।

তাই অন্যান্য সৃষ্টির সম্পূর্ণ বিপরীত তোমাকে বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছি এবং তোমার সামনে শোকর ও কুফরের দুটি পথ স্পষ্ট করে রেখে দেয়া হয়েছে। এখানে কাজ করার জন্য তোমাকে কিছু সময়ও দেয়া হয়েছে। এখন আমি দেখতে চাই এ সময়ের মধ্যে কাজ করে অর্থাৎ এভাবে গৃহীত পরীক্ষার মাধ্যমে তুমি নিজেকে শোকরগোজার বান্দা হিসেবে প্রমাণ করো না কাফের বান্দা হিসেবে প্রমাণ করো। অতপর যারা এ পরীক্ষায় কাফের বলে প্রমাণিত হবে আখেরাতে তাদের কি ধরনের পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে তা শুধু একটি আয়াতের মাধ্যমেই পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে।

তারপর আয়াত নং ৫ থেকে ২২ পর্যন্ত একাদিক্রমে সেসব পুরস্কার ও প্রতিদানের কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা দিয়ে সেসব লোকদের তাদের রবের কাছে অভিষিক্ত করা হবে, যারা এখানে যথাযথভাবে বন্দেগী করেছে। এ আয়াতগুলোতে শুধুমাত্র তাদের সর্বোত্তম প্রতিদান দেয়ার কথার বর্ণনা করাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়নি, বরং সংক্ষেপে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, কি কি কাজের জন্য তারা এ প্রতিদান লাভ করবে। মক্কী যুগে অবতীর্ণ সূরাসমূহের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হলো, তাতে ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়ার সাথে সাথে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিতে অতি মূল্যবান নৈতিক গুণাবলী এবং নেক কাজের কথাও বর্ণনা করা হয়েছে।

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন সব কাজ-কর্ম ও এমন সব মন্দ নৈতিক দিকের উল্লেখ করা হয়েছে যা থেকে ইসলাম মানুষকে পবিত্র করতে চায়। আর দুনিয়ার এ অস্থায়ী জীবনে ভাল অথবা মন্দ কি ধরনের ফলাফল প্রকাশ পায় সেদিক বিবেচনা করে এ দুটি জিনিস বর্ণনা করা হয়নি, বরং আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে তার স্থায়ী ফলাফল কি দাঁড়াবে কেবল সে দিকটি বিবেচনা করেই তা বর্ণনা করা হয়েছে। দুনিয়ার এ জীবনে কোনো খারাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট কল্যাণকর প্রমাণিত হোক বা কোনো ভাল চারিত্রিক গুণ ক্ষতিকর প্রমাণিত হোক তা এখানে বিবেচ্য নয় । এ পর্যন্ত প্রথম রুকূ’র বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হলো। এরপর দ্বিতীয় রুকূ’তে রসূলুল্লাহ সা.-কে সম্বোধন করে তিনটি কথা বলা হয়েছে।

এক, এ কুরআনকে অল্প অল্প করে তোমার ওপরে আমিই নাযিল করছি। এর উদ্দেশ্য নবী সা.-কে সাবধান করে দেয়া নয়, বরং কাফেরদের সাবধান করে দেয়া। কাফেরদের সাবধান করা হয়েছে এই বলে যে, কুরআন মজীদ মুহাম্মদ সা.-এর মনগড়া বা স্বরচিত গ্রন্থ নয়, বরং তার নাযিলকর্তা আমি নিজে । আমার জ্ঞান ও কর্মকৌশলের দাবী হলো, আমি যেন তা একবারে নাযিল না করি বরং অল্প অল্প করে বারে বারে নাযিল করি।

দ্বিতীয় যে কথাটি নবী সা.-কে বলা হয়েছে তাহলো, তোমার রবের ফয়সালা আসতে যত দেরীই হোক না কেন এবং এ সময়ের মধ্যে তোমার ওপর দিয়ে যত কঠিন ঝড়-ঝঞ্ঝাই বয়ে যাক না কেন তুমি সর্বাবস্থায় ধৈর্যের সাথে তোমার রিসালাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে থাকো। কখনো এসব দুষ্কর্মশীল ও সত্য অস্বীকারকারী লোকদের কারো চাপে পড়ে নতি স্বীকারও করবে না।

তৃতীয় যে কথাটি তাঁকে বলা হয়েছে তাহলো, রাত দিন সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করো, নামায পড় এবং আল্লাহর ইবাদাতে রাত কাটিয়ে দাও। কারণ কুফরের বিধ্বংসী প্লাবনের মুখে এ জিনিসটিই আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের পা-কে দৃঢ় ও মযবুত করে। এরপর আরেকটি ছোট বাক্যে কাফেরদের ভ্রান্ত আচরণের মূল কারণ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, তারা আখেরাতকে ভুলে দুনিয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় আরেকটি বাক্যে তাদের এ মর্মে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা নিজে নিজেই জন্ম লাভ করোনি। আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, বুকের এ চওড়া ছাতি এবং মযবুত ও সবল হাত-পা তুমি নিজেই নিজের জন্য বানিয়ে নাওনি। ওগুলোও আমি তৈরি করেছি। আমি তোমাদের যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। সবসময়ের জন্য সে ক্ষমতা আমার করায়ত্ব। আমি তোমাদের চেহারা ও আকৃতি বিকৃত করে দিতে পারি। তোমাদের ধ্বংস করে অন্য কোনো জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারি। তোমাদের মেরে ফেলার পর যে চেহারা ও আকৃতিতে ইচ্ছা পুনরায় তোমাদের সৃষ্টি করতে পারি ।

সবশেষে এ বলে বক্তব্য শেষ করা হয়েছে যে, এ কুরআন একটি উপদেশপূর্ণ বাণী। যার ইচ্ছা সে গ্রহণ করে তার প্রভুর পথ অবলম্বন করতে পারে। তবে দুনিয়াতে মানুষের ইচ্ছা সবকিছু নয়। আল্লাহর ইচ্ছা না হওয়া পর্যন্ত কারো ইচ্ছাই পূরণ হতে পারে না। তবে আল্লাহর ইচ্ছা অযৌক্তিতভাবে হয় না। তিনি যা-ই ইচ্ছা করুন না কেন তা হয় নিজের জ্ঞান ও কর্মকৌশলের আলোকে । এ জ্ঞান ও কর্মকৌশলের ভিত্তিতে তিনি যাকে তাঁর রহমতলাভের উপযুক্ত মনে করেন তাকে নিজের রহমতের অন্তরভুক্ত করে নেন। আর তাঁর কাছে যে যালেম বলে প্রমাণিত হয় তার জন্য তিনি অত্যন্ত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন ।

সূরা দাহর এর তাফসির

সূরা দাহর আয়াত-১
আয়াতের প্রথমাংশ হলো هَلْ أَتَىٰ عَلَى الْإِنسَانِ এখানে অধিকাংশ মুফাস্সির ও অনুবাদক هَلْ শব্দটিকে ; قد শব্দের অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং এর অর্থ করেছেন—নিঃসন্দেহে মানুষের ওপরে এরূপ একটি সময় এসেছিল। তবে هَلْ আরবী ভাষায় মূলতঃ ‘কি’র অর্থেই ব্যবহৃত হয়। সর্বাবস্থায় এর দ্বারা প্রশ্ন করা বুঝায় না। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে প্রশ্নবোধক এ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে বলা হয়ে থাকে। যেমন কখনো আমরা জানতে চাই যে, অমুক ঘটনা ঘটেছিল না ঘটেনি ? আর সেজন্য কাউকে জিজ্ঞেস করি, এ ধরনের ঘটনা কি ঘটেছিল ?

কোনো কোনো সময় আবার প্রশ্ন করা আমাদের উদ্দেশ্য হয় না, বরং উদ্দেশ্য হয় কোনো বিষয় অস্বীকার করা। তখন যে বাচনভংগি ব্যবহার করে আমরা তা অস্বীকার করি, তাহলো অন্য কেউও কি এ কাজ করতে পারে ? কোনো সময় আমরা কারো থেকে কোনো বিষয়ে স্বীকৃতি পেতে চাই এবং এ উদ্দেশ্যে তাকে জিজ্ঞেস করি, আমি কি তোমার টাকা পরিশোধ করেছি ? কোনো সময় আবার শুধু স্বীকৃতি আদায় করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য হয় না, বরং তখন আমরা প্রশ্ন করি শ্রোতার মন মগজকে আরো একটি বিষয় ভাবতে বাধ্য করার জন্য যা তার স্বীকৃতির অনিবার্য ফলস্বরূপ দেখা দেয়।

যেমন আমরা কাউকে জিজ্ঞেস করি, আমি কি তোমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেছি ? এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য শুধু এতটুকুই নয় যে, সে স্বীকার করুক, আপনি তার সাথে সত্যিই কোনো খারাপ আচরণ করেননি। বরং এর উদ্দেশ্য তাকে একথাও চিন্তা করতে বাধ্য করা যে, যে ব্যক্তি আমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেনি তার সাথে আমার খারাপ আচরণ করা কতটুকু ন্যায় সংগত ? আলোচ্য আয়াতের প্রশ্নবোধক অংশটুকু প্রকৃতপক্ষে এ শেষ অর্থেই বলা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য মানুষকে শুধু এতটুকু স্বীকার করানো নয় যে, তার ওপরে এমন একটি সময় সত্যিই অতিবাহিত হয়েছে।

বরং এর দ্বারা তাকে এ বিষয়ও চিন্তা করতে বাধ্য করা উদ্দেশ্য যে, যে আল্লাহ এমন নগণ্য অবস্থা থেকে সৃষ্টির সূচনা করে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন তিনি তাকে পুনরায় সৃষ্টি করতে অক্ষম হবেন কেন ?

আয়াতের দ্বিতীয় অংশ হলো دَّهْرِ ; حِينٌ مِّنَ الدَّهْرِ, অর্থ-অন্তহীন মহাকাল যার আদি-অস্ত কিছুই মানুষের জানা নেই। আর حِينٌ অর্থ অন্তহীর্ন মহাকালের বিশেষ একটি সময় এ মহাকাল প্রবাহের কোনো এক পর্যায়ে যার আগমন ঘটেছিল। বক্তব্যের সারমর্ম হলো, এ অন্তহীন মহাকালের মধ্যে একটি দীর্ঘ সময় তো এমন অতিবাহিত হয়েছে যখন মানব প্রজাতির আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তারপর এ মহাকাল প্রবাহে এমন একটি সময় আসলো যখন মানুষ নামের একটি প্রজাতির সূচনা করা হলো। এ সময়-কালে প্রত্যেক মানুষের জন্য এমন একটি সময় এসেছে যখন তাকে শূন্য মাত্রা বা অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বদানের সূচনা করা হয়েছে।

আয়াতের তৃতীয় অংশ হলো لَمْ يَكُن شَيْئًا مَّذْكُورًا
অর্থাৎ, তখন সে কোনো উল্লেখযোগ্য বস্তুই ছিল না। তার একটি অংশ বাপের শুক্রের মধ্যে অণুবীক্ষণিক জীবাণু আকারে এবং আরেকটি অংশ মায়ের বীর্যে একটি অণুবিক্ষণিক ডিম্বের আকারে বর্তমান ছিল । দীর্ঘকাল পর্যন্ত মানুষ এ বিষয়ও জানতো না যে, একটি শুক্রকীট এবং একটি ডিম্বকোষের মিলনের ফলেই সে অস্তিত্ব লাভ করে। বর্তমানে অত্যন্ত শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সে এ দু’টিকে দেখতে সক্ষম হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো কেউ বলতে পারে না যে, পিতার এ শুক্রকীটে এবং মায়ের ডিম্বকোষে কত সংখ্যক মানুষের অস্তিত্ব থাকে।

গর্ভসঞ্চারকালে এ দু’টি জিনিসের মিলনে যে প্রাথমিক কোষ (Cell) সৃষ্টি হয় তা পরিমাণহীন এমন একটি পরমাণু যা কেবল অত্যন্ত শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেই দেখা যেতে পারে। আর তা দেখার পরেও আপাত দৃষ্টিতে কেউ একথা বলতে পারে না যে, এভাবে কোনো মানুষ জন্মলাভ করছে কিংবা এ নগণ্য সূচনা বিন্দু থেকে বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে কোনো মানুষ যদি সৃষ্টি হয়ও তাহলে সে কেমন দৈহিক উচ্চতা ও কাঠামো, কেমন আকার-আকৃতি এবং কেমন যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বধারী মানুষ হবে তাও বলতে পারে না। সে সময় সে কোনো উল্লেখযোগ্য বস্তুই ছিল না, এ বাণীর তাৎপর্য এটাই। যদিও মানুষ হিসেবে সে সময় তার অস্তিত্বের সূচনা হয়ে গিয়েছিল।

সূরা দাহর আয়াত-২
এক সংমিশ্রিত বীর্য দ্বারা অর্থ হলো, মানুষের সৃষ্টি পুরুষ ও নারীর দু’টি আলাদা বীর্য দ্বারা হয়নি। বরং দু’টি বীর্য সংমিশ্রিত হয়ে যখন একটি হয়ে গিয়েছে তখন সে সংমিশ্রিত বীর্য থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে।

এটাই হলো দুনিয়ায় মানুষের এবং মানুষের জন্য দুনিয়ার প্রকৃত অবস্থান ও মর্যাদা। মানুষ নিছক গাছপালা বা জীব-জন্তুর মত নয় যে, তার সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য এখানেই পূরণ হয়ে যাবে এবং প্রকৃতির নিয়মানুসারে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার নিজের অংশের করণীয় কাজ সম্পাদন করার পর এখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাছাড়া এ দুনিয়া তার জন্য আযাব বা শাস্তির স্থান নয় যেমনটা খৃস্টান পাদ্রীরা মনে করে, প্রতিদানের ক্ষেত্রও নয় যেমনটা জন্মান্তরবাদীরা মনে করে, চারণ ক্ষেত্র বা বিনোদন কেন্দ্র নয় যেমনটা বস্তুবাদীরা মনে করে, আবার দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম ক্ষেত্রও নয় যেমনটা ডারউইন ও মার্কসের অনুসারীরা মনে করে থাকে।

বরং দুনিয়া মূলত তার জন্য একটা পরীক্ষাগার। যে জিনিসকে সে বয়স বা আয়ুষ্কাল বলে মনে করে আসলে তা পরীক্ষার সময় যা তাকে এ দুনিয়ায় দেয়া হয়েছে। দুনিয়ায় যে ক্ষমতা ও যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়েছে, যেসব বস্তুকে কাজে লাগানোর সুযোগ তাকে দেয়া হয়েছে, যে মর্যাদা নিয়ে বা অবস্থানে থেকে সে এখানে কাজ করছে এবং তার ও অন্যান্য মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান তার সবই মূলত অসংখ্য পরীক্ষা পত্র। জীবনের সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে এ পরীক্ষা চলবে। এ পরীক্ষার ফলাফল দুনিয়ায় প্রকাশ পাবে না। বরং আখেরাতে তার সমস্ত পরীক্ষা পত্র পরীক্ষা ও যাঁচাই বাছাই করে ফয়সালা দেয়া হবে। সে সফল না বিফল।

তার সফলতা ও বিফলতার সবটাই নির্ভর করবে এ বিষয়ের ওপর যে, সে তার নিজের সম্পর্কে কি ধারণা নিয়ে এখানে কাজ করেছে এবং তাকে দেয়া পরীক্ষার পত্রসমূহে সে কিভাবে জবাব লিখেছে। নিজের সম্পর্কে সে যদি মনে করে থাকে যে, তার কোনো আল্লাহ নেই অথবা নিজেকে সে বহু সংখ্যক ইলাহর বান্দা মনে করে থাকে এবং পরীক্ষার সবগুলো পত্রে এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে জবাব লিখে থাকে

যে, আখেরাতে তাকে তার স্রষ্টার সামনে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না তাহলে তার জীবনের সমস্ত কর্মকাণ্ড ভুল হয়ে গিয়েছে। আর যদি সে নিজেকে একমাত্র আল্লাহর বান্দা মনে করে আল্লাহর মনোনীত পথ ও পন্থা অনুসারে কাজ করে থাকে এবং আখেরাতে জবাবদিহির চেতনা বিবেচনায় রেখে তা করে থাকে তাহলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেলো। (এ বিষয়টি কুরআন মজীদে এত অধিক জায়গায় ও এত বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এখানে স্থানগুলোর নাম উল্লেখ করা বেশ কঠিন। যারা এ বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝতে চান তারা তাফহীমুল কুরআনের প্রত্যেক খণ্ডের শেষে সংযুক্ত বিষয়সূচীর মধ্যে পরীক্ষা শব্দটি বের করে সেসব স্থান দেখুন যেখানে কুরআন মজীদে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

কুরআন ছাড়া পৃথিবীতে এমন আর কোনো গ্রন্থ নেই যার মধ্যে এ সত্যটি এত বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আসলে বলা হয়েছে আমি তাকে سـمـبع ও بصير বানিয়েছি। বিবেকবুদ্ধির অধিকারী করেছি। বললে এর সঠিক অর্থ প্রকাশ পায়। কিন্তু অনুবাদে আমি سـمـبع শব্দের অর্থ “শ্রবণশক্তির অধিকারী” এবং بصير শব্দের অর্থ ‘দৃষ্টিশক্তির অধিকারী’ করেছি। যদিও এটিই আরবী ভাষার এ দু’টি শব্দের শাব্দিক অনুবাদ। কিন্তু আরবী ভাষায় অভিজ্ঞ প্রত্যেক ব্যক্তিই জানেন যে, জন্তু-জানোয়ারের জন্য কখনো سـمـبع ও بصير শব্দ ব্যবহৃত হয় না। অথচ জন্তু-জানোয়ারও দেখতে এবং শুনতে পায়।

অতএব এখানে শোনা এবং দেখার অর্থ শোনার ও দেখার সে শক্তি নয় যা জন্তু-জানোয়ারকেও দেয়া হয়েছে। এখানে এর অর্থ হলো, শোনা ও দেখার সেসব উপায়-উপকরণ যার সাহায্যে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। তাছাড়া শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি যেহেতু মানুষের জ্ঞানার্জনের উপায়- উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাই সংক্ষেপে এগুলোরই উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ যেসব ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জ্ঞান অর্জন করে থাকে আসলে এসব ইন্দ্রিয়ের সবগুলোই এখানে বুঝানো হয়েছে।

তাছাড়া মানুষকে যেসব ইন্দ্রিয় ও অনুভূতি শক্তি দেয়া হয়েছে তা ধরন ও প্রকৃতিগত দিক দিয়ে পশুদের ইন্দ্রিয় ও অনুভূতি শক্তি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ মানুষের প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের পেছনে একটি চিন্তাশীল মন-মগজ বর্তমান যা ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান ও তথ্যসমূহকে একত্রিত ও বিন্যস্ত করে তা থেকে ফলাফল বের করে মতামত স্থির করে এবং এমন কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যার ওপরে তার কার্যকলাপ ও আচরণের ভিত্তি স্থাপিত হয় ।

তাই মানুষকে সৃষ্টি করে আমি তাকে পরীক্ষা করতে চাচ্ছিলাম একথাটি বলার পর আমি এ উদ্দেশ্যেই তাকে سميع ও بصير অর্থাৎ ‘শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি’ কথাটি বলার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির শক্তি দিয়েছেন যাতে সে পরীক্ষা দেয়ার উপযুক্ত হতে পারে। বাক্যটির অর্থ যদি এটা না হয় এবং سميع ও بصير বানানোর অর্থ যদি শুধু শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী বানানো হয় তাহলে অন্ধ ও বধির ব্যক্তিরা এ পরীক্ষা থেকে বাদ পড়ে যায় অথচ জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি থেকে যদি কেউ পুরোপুরি বঞ্চিত না হয় তাহলে তার এ পরীক্ষা থেকে বাদ পড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

সূরা দাহর আয়াত-৩
অর্থাৎ আমি তাকে শুধু জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই ছেড়ে দেইনি। বরং এগুলো দেয়ার সাথে সাথে তাকে পথও দেখিয়েছি যাতে সে জানতে পারে শোকরিয়ার পথ কোনটি এবং কুফরীর পথ কোনটি । এরপর যে পথই সে অবলম্বন করুক না কেন তার জন্য সে নিজেই দায়ী। এ বিষয়টিই সূরা বালাদে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে وهد ينه النجدين “আমি তাকে দু’টি পথ (অর্থাৎ ভাল ও মন্দ পথ) স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছি।” সূরা শামসে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে এভাবেঃ “শপথ (মানুষের) প্রবৃত্তির আর সে সত্তার যিনি তাকে (সর্ব রকম বাহ্যিক) ও আভ্যন্তরীণ শক্তি দিয়ে শক্তিশালী করেছেন।

আর পাপাচার ও তাকওয়া-পরহেজগারীর অনুভূতি দু’টোই তার ওপর ইলহাম করেছেন।” এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সামনে রেখে বিচার করলে এবং পৃথিবীতে মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তা’আলা যেসব ব্যবস্থার কথা কুরআন মজীদে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তাও সামনে রাখলে বুঝা যায় যে, এ আয়াতে পথ দেখানোর যে কথা বলা হয়েছে তার দ্বারা পথপ্রদর্শনের কোনো একটি মাত্র পন্থা ও উপায় বুঝানো হয়নি। বরং এর দ্বারা অনেক পন্থা ও উপায়ের কথা বলা হয়েছে যার কোনো সীমা পরিসীমা নেই যেমন,

এক : প্রত্যেক মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির যোগ্যতা দেয়ার সাথে সাথে তাকে একটি নৈতিক বোধ ও অনুভূতি দেয়া হয়েছে যার সাহায্যে সে প্রকৃতিগতভাবেই ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করে, কিছু-কর্ম ও বৈশিষ্টকে খারাপ বলে জানে যদিও সে নিজেই তাতে লিপ্ত। আবার কিছু কাজ-কর্ম ও গুণাবলীকে ভালো বলে মনে করে যদিও সে নিজে তা থেকে দূরে অবস্থান করে।

এমন কি যেসব লোক তাদের স্বার্থ ও লোভ-লালসার কারণে এমন সব দর্শন রচনা করেছে যার ভিত্তিতে তারা অনেক খারাপ ও পাপকার্যকেও নিজেদের জন্য বৈধ করে নিয়েছে তাদের অবস্থাও এমন যে, সে একই মন্দ কাজ করার অভিযোগ যদি কেউ তাদের ওপর আরোপ করে, তাহলে তারা প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠবে এবং তখনই জানা যায় যে, নিজের মিথ্যা ও অলীক দর্শন সত্ত্বেও বাস্তবে তারা নিজেরাও সেসব কাজকে খারাপই মনে করে থাকে। অনুরূপ ভালো কাজ ও গুণাবলীকে কেউ মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা এবং সেকেলে ঠাওরিয়ে রাখলেও কোনো মানুষের কাছ থেকে তারা যখন নিজেরাই নিজেদের সদাচরণের সুফল বা উপকার লাভ করে তখন তারা সেটিকে মূল্যবান মনে করতে বাধ্য হয়ে যায়।

দুই : প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আল্লাহ তা’আলা বিবেক (তিরস্কারকারী নফস) বলে একটি জিনিস রেখে দিয়েছেন। যখন সে কোনো মন্দ কাজ করতে উদ্যত হয় অথবা করতে থাকে অথবা করে ফেলে তখন এ বিবেকই তাকে দংশন করে। যতই হাত বুলিয়ে বা আদর-সোহাগ দিয়ে মানুষ এ বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে দিক, তাকে অনুভূতিহীন বানানোর যত চেষ্টাই সে করুক সে তাকে একদম নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম নয়।

হঠকারী হয়ে দুনিয়ায় সে নিজেকে চরম বিবেকহীন প্রমাণ করতে পারে, সে সুন্দর সুন্দর অজুহাত খাড়া করে দুনিয়াকে ধোঁকা দেয়ার সব রকম প্রচেষ্টা চালাতে পারে, সে নিজের বিবেককে প্রতারিত করার জন্য নিজের কর্মকাণ্ডের সপক্ষে অসংখ্য ওজর পেশ করতে পারে; কিন্তু এসব সত্ত্বেও আল্লাহ তার স্বভাব-প্রকৃতিতে যে হিসেব পরীক্ষককে নিয়োজিত রেখেছেন সে এত জীবন্ত ও সজাগ যে, সে নিজে প্রকৃতপক্ষে কি তা কোনো অসৎ মানুষের কাছেও গোপন থাকে না। সূরা আল কিয়ামাহতে একথাটিই বলা হয়েছে যে, “মানুষ যত ওজরই পেশ করুক না কেন সে নিজেকে খুব ভালো করেই জানে।” (আয়াত ১৫)

তিন : মানুষের নিজের সত্তায় এবং তার চারপাশে জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত গোটা বিশ্ব-জাহানের সর্বত্র এমন অসংখ্য নিদর্শনাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, এতসব জিনিস কোনো আল্লাহ ছাড়া হতে পারে না কিংবা বহু সংখ্যক খোদা এ বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তা বা পরিচালক হতে পারে না। বিশ্ব চরাচরের সর্বত্র এবং মানুষের আপন সত্তার অভ্যন্তরে বিদ্যমান এ নিদর্শনাবলীই কিয়ামত ও আখেরাতের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করছে।

মানুষ যদি এসব থেকে চোখ বন্ধ করে থাকে অথবা বুদ্ধি-বিবেক কাজে লাগিয়ে এসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে অথবা তা যেসব সত্যের প্রতি ইংগিত করছে তা মেনে নিতে টালবাহানা ও গড়িমসি করে তাহলে তা তার নিজেরই অপরাধ। আল্লাহ তা’আলা নিজের পক্ষ থেকে তার সামনে সত্যের সন্ধানদাতা নিদর্শনাদি পেশ করতে আদৌ কোনো অসম্পূর্ণতা রাখেনি।

চার : মানুষের নিজের জীবনে, তার সমসাময়িক পৃথিবীতে এবং তার পূর্বের অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় এমন অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং হয়ে থাকে যা প্রমাণ করে যে, একটি সর্বোচ্চ ক্ষমতার শাসন-কর্তৃত্ব তার ওপর এবং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন যাঁর সামনে সে নিতান্তই অসহায়।

যাঁর ইচ্ছা সবকিছুর ওপর বিজয়ী এবং যাঁর সাহায্যের সে মুখাপেক্ষী এসব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ বাহ্যিক ক্ষেত্রসমূহেই শুধু এ সত্যের প্রমাণ পেশ করে না। বরং মানুষের নিজের প্রকৃতির মধ্যেও সে সর্বোচ্চ শাসন-কর্তৃত্বের প্রমাণ বিদ্যমান যার কারণে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে খারাপ সময়ে নাস্তিকরাও আল্লাহর সামনে প্রার্থনার হাত প্রসারিত করে এবং কট্টর মুশরিকরাও সব মিথ্যা খোদাকে পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে শুরু করে।

পাঁচ : মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও প্রকৃতিগত জ্ঞানের অকাট্য ও চূড়ান্ত রায় হলো অপরাধের শাস্তি এবং উত্তম কার্যাবলীর প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া উচিত। এ উদ্দেশ্যে দুনিয়ার প্রত্যেক সমাজে কোনো না।কোনো রূপে বিচার ব্যবস্থা কায়েম করা হয় এবং যেসব কাজ-কর্ম প্রশংসনীয় বলে মনে করা হয় তার জন্য পুরস্কার ও প্রতিদান দেয়ারও কোনো না কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় । এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, নৈতিকতা এবং প্রতিদান বা ক্ষতিপূরণ আইনের মধ্যে এমন একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান যা অস্বীকার করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয় ।

একথা যদি স্বীকার করা হয় যে, এ পৃথিবীতে এমন অসংখ্য অপরাধ আছে যার যথাযোগ্য শাস্তি তো দূরের কথা আদৌ কোনো শাস্তি দেয়া যায় না এবং এমন অসংখ্য সেবামূলক ও কল্যাণকর কাজ আছে যার যথাযোগ্য প্রতিদান তো দূরের কথা কাজ সম্পাদনকারী আদৌ কোনো প্রতিদান লাভ করতে পারে না তাহলে আখেরাতকে মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

তবে কোনো নির্বোধ যদি মনে করে অথবা কোনো হঠকারী ব্যক্তি যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকে যে, ন্যায় ও ইনসাফের ধারণা পোষণকারী মানুষ এমন এক পৃথিবীতে জন্মলাভ করে ফেলেছে যেখানে ন্যায় ও ইনসাফের ধারণা একেবারেই অনুপস্থিত তবে সেটা আলাদা কথা, এরপর অবশ্য একটি প্রশ্নের জওয়াব দেয়া তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে পড়ে । তাহলো, এমন এক বিশ্বে জন্মলাভকারী মানুষের মধ্যে ইনসাফের এ ধারণা এলো কোথা থেকে ?

ছয় : এসব উপায়-উপকরণের সাহায্যে মানুষকে হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে নবী পাঠিয়েছেন এবং কিতাব নাযিল করেছেন। এসব কিতাবে পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে, শোকরের পথ কোনটি ও কুফরের পথ কোনটি এবং এ দু’টি পথে চলার পরিণামই বা কি ?

নবী-রাসূল এবং তাঁদের আনীত কিতাবসমূহের শিক্ষা জানা-অজানা, দৃশ্য-অদৃশ্য অসংখ্য উপায় ও পন্থায় এত ব্যাপকভাবে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে যে, কোনো জনপদই আল্লাহ ও আখেরাতের ধারণা, সৎ ও অসৎ কাজের পার্থক্য বোধ এবং তাঁদের পেশকৃত নৈতিক নীতিমালা ও আইন-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ নয়, নবী-রসূলদের আনীত কিতাবসমূহের শিক্ষা থেকেই তারা এ জ্ঞান লাভ করেছে তা তাদের জানা থাক বা না থাক। বর্তমানে যেসব লোক নবী-রসূলগণ এবং আসমানী কিতাবসমূহ অস্বীকার করে অথবা তাঁদের সম্পর্কে কোনো খবরই রাখে না তারাও এমন অনেক জিনিস অনুসরণ করে থাকে যা মূলত ঐ সব শিক্ষা থেকে উৎসারিত ও উৎপন্ন হয়ে তাদের কাছে পৌঁছেছে। অথচ মূল উৎস কি সে সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না।

সূরা দাহর আয়াত-৪-৫
মূল আয়াতে ابرار শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ এমন সব মানুষ যারা পুরোপুরি তাদের রবের আনুগত্য করেছে, তাঁর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ পালন করেছে এবং তাঁর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বিরত রয়েছে।

সূরা দাহর আয়াত-৬ ৭.
অর্থাৎ তা কর্পূর মিশ্রিত পানি হবে না, বরং তা হবে এমন একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা যার পানি হবে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন এবং শীতল আর তার খোশবু হবে অনেকটা কপূরের মত।

عباد الله (আল্লাহর বান্দা) কিংবা عباد الرحمن (রাহমানের বান্দা) শব্দগুলো আভিধানিক অর্থে সমস্ত মানুষের জন্যই ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ সবাই আল্লাহর বান্দা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরআন মজীদের যেখানেই এ ধরনের শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার দ্বারা আল্লাহর নেককার বান্দাগণকেই বুঝানো হয়েছে। অসৎলোক, যারা নিজেরাই নিজেদেরকে আল্লাহর বন্দেগী তথা দাসত্বের বাইরে রেখেছে, তারা যেন এর যোগ্য-ই নয় যে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে নিজের মহান নামের সাথে যুক্ত করে عباد الله অথবা عباد الرحمن এর মত সম্মানিত উপাধিতে ভূষিত করবেন।

এর দ্বারা বুঝায় না যে, তারা সেখানে কোদাল ও খন্তা নিয়ে নালা খনন করবে এবং এভাবে উক্ত ঝর্ণার পানি যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যাবে। বরং এর অর্থ হলো, জান্নাতের মধ্যে যেখানেই তারা চাইবে সেখানেই এ ঝর্ণা বইতে থাকবে। এজন্য তাদের নির্দেশ বা ইংগিতই যথেষ্ট হবে। সহজেই বের করে নেবে কথাটি এ বিষয়টির প্রতিই ইংগিত করে।

সূরা দাহর আয়াত-৭
‘নযর’ বা মানত পূরণ করার একটা অর্থ হলো, মানুষের ওপর যা কিছু ওয়াজিব করা হয়েছে তা তারা পূরণ করবে। দ্বিতীয় অর্থ হলো, মানুষ তার নিজের ওপর যা ওয়াজিব করে নিয়েছে কিংবা অন্য কথায় সে যে কাজ করার সংকল্প বা ওয়াদা করেছে তা পূরণ করবে। তৃতীয় অর্থ হলো, ব্যক্তির ওপরে যা ওয়াজিব তা সে পূরণ করবে। তা তার ওপর ওয়াজিব করা হয়ে থাকুক অথবা সে নিজেই তার ওপর ওয়াজিব করে নিয়ে থাকুক। এ তিনটি অর্থের মধ্যে দ্বিতীয় অর্থটি বেশী পরিচিত এবং ‘নযর’ শব্দ দ্বারা সাধারাণত এ অর্থটিই বুঝানো হয়ে থাকে। যাই হোক, এখানে ঐ সমস্ত লোকের প্রশংসা হয়তো এ জন্য করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা’আলার নির্ধারিত ওয়াজিবসমূহ পালন করে।

অথবা এজন্য তাদের প্রশংসা করা হয়েছে যে, তারা অত্যন্ত সৎ মানুষ। যেসব ওয়াজিব বা করণীয় আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন সেগুলো পালনের ব্যাপারে কোনো রকম ত্রুটি করা তো দূরের কথা যেসব ভালো ও কল্যাণকর কাজ আল্লাহ তাদের জন্য ওয়াজিব বা করণীয় করে দেননি তারা যখন আল্লাহর কাছে সে কাজ করার ওয়াদা করে তখন সে ওয়াদাও পালন করে।

মানতের বিধি-বিধান ও হুকুম-আহকাম তাফহীমুল কুরআনে সূরা বাকারার ৩১০ টীকায় আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি। তবে এখানে তা আরো একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যথার্থ বলে মনে করছি। যাতে এ ব্যাপারে মানুষ যেসব ভুল করে অথবা যেসব ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে দেখা যায় তা থেকে আত্মরক্ষা করতে এবং এর সঠিক নিয়ম-কানুন অবহিত হতে পারে।

এক. ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণের মতে ‘নযর’ বা মানত চার প্রকারের।

এক. এক ব্যক্তি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করলো যে, সে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য অমুক নেক কাজ সম্পাদন করবে।

দুই. সে মানত করলো যে, আল্লাহ যদি আমার অমুক প্রয়োজন পূরণ করেন তাহলে আমি শুকরিয়া হিসেবে অমুক নেক কাজ করবো। এ দুই প্রকারের মানতকে ফিকাহবিদের পরিভাষায় ‘নযরে তাবাররুর’ বা নেক কাজের মানত বলা হয় এবং এ ব্যাপারে তারা একমত যে, এ নযর পূরণ করা ওয়াজিব।

তিন. কোনো ব্যক্তির কোনো নাজায়েয কাজ করার কিংবা কোনো ওয়াজিব কাজ না করার সংকল্প করা।

চার. কোনো ব্যক্তির কোনো মুবাহ কাজ করা নিজের জন্য ওয়াজিব করে নেয়া অথবা কোনো অবাঞ্ছিত কাজ করার সংকল্প করা।

এ দু’প্রকারের মানকে ফিকাহবিদদের পরিভাষায় ‘নযরে লাজাজ” (মূর্খতা, ঝগড়াটেপনা ও হঠকারিতামূলক মানত) বলে । এর মধ্যে তৃতীয় প্রকারের মানত সম্পর্কে সব ফিকাহবিদদের ঐকমত্য হলো, তা মানত হিসেবে পরিগণিত হয় না। চতুর্থ প্রকারের মানত সম্পর্কে ফিকাহবিদগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কোনো কোনো ফিকাহবিদ বলেছেন : এ মানত পূরণ করা কর্তব্য। কেউ কেউ বলেন, শপথ ভংগের কাফফারা দিতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেন, ব্যক্তি ইচ্ছা করলে মানত পূরণ করতে পারে কিংবা কাফফারা দিতে পারে। এ ব্যাপারে তার স্বাধীনতা রয়েছে। শাফেয়ী এবং মালেকীদের মতে এ প্রকারের মানতও আদৌ মানত হিসেবে গণ্য হয় না। আর হানাফীদের মতে এ দু’ প্রকারের মানতের জন্য কাফফারা দেয়া আবশ্যিক হয়ে যায়। (উমদাতুল কারী)

সূরা দাহর আয়াত ৭-৮
মূল শব্দ হলো على حبه অধিকাংশ মুফাস্সির حبه এর ه শব্দটিকে (طعام) খাদ্যের সর্বনাম হিসেবে নির্ধারিত করেছেন। তাঁরা এর অর্থ বর্ণনা করেছেন যে, খাদ্য অত্যন্ত প্রিয় ও আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও এবং নিজেরাই খাদ্যের মুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও নেককার লোকেরা তা অন্যদেরকে খাওয়ান। ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদ রা. বলেন, এর অর্থ হলো, على حبه طعام অর্থাৎ, গরীব ও দুস্থদের খাওয়ানোর আকাংখ্যা ও উৎসাহের কারণে তারা এ কাজ করে থাকে। হযরত ফুদাইল ইবনে আয়ায ও আবু সুলায়মান আদ-দারানী বলেন, তারা আল্লাহ তা’আলার মহব্বতে এরূপ করে। আমাদের
মতে পরবর্তী আয়াতাংশে إنما نطعمكم لوجه الله (আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যেই তোমাদের খাওয়াচ্ছি) এ অর্থকেই সমর্থন করে।

প্রাচীনকালে রীতি ছিল বন্দীদের হাতকড়া ও বেড়ী পরিয়ে প্রতিদিন বাইরে বের করে আনা হতো। তারপর তারা রাস্তায় রাস্তায় ও মহল্লায় মহল্লায় ভিক্ষা করে ক্ষুধা নিবারণ করতো। পরবর্তীকালে ইসলামী সরকার এ কুপ্রথাকে উচ্ছেদ করে। (কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফ, পৃষ্ঠা ১৫০, মুদ্রণ ১৩৮২ হিঃ) এ আয়াতে বন্দী বলতে কাফের হোক বা মুসলমান, যুদ্ধবন্দী হোক বা অপরাধের কারণে বন্দী হোক, সর্বাবস্থায় একজন অসহায় মানুষকে—যে তার খাবার সংগ্রহের জন্য নিজে কোনো চেষ্টা করতে পারে না—খাবার দেয়া অতি বড় নেকী ও সওয়াবের কাজ।

কোনো গরীবকে খেতে দেয়া যদিও বড় নেকীর কাজ কিন্তু কোনো অভাবী মানুষের অন্যান্য অভাব পূরণ করাও একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে খেতে দেয়ার মতই নেক কাজ। যেমন কেউ কাপড়ের মুখাপেক্ষী, কেউ অসুস্থ, তাই চিকিৎসার মুখাপেক্ষী অথবা কেউ ঋণগ্রস্থ, পাওনাদার তাকে অস্থির ও অতিষ্ঠ করে তুলছে। এসব লোককে সাহায্য করা খাবার খাওয়ানোর চেয়ে কম নেকীর কাজ নয়। তাই এ আয়াতটিতে নেকীর একটি বিশেষ অবস্থা ও ক্ষেত্রকে তার গুরুত্বের কারণে উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে মাত্র। অন্যথায় এর মূল উদ্দেশ্য অভাবীদের সাহায্য করা।

সূরা দাহর আয়াত-৯ ১৪.
গরীবদের খাবার দেয়ার সময় মুখে একথা বলতে হবে এমনটা জরুরী নয় । মনে মনেও একথা বলা যেতে পারে। আল্লাহর কাছে মুখে বলার যে মর্যাদা এভাবে বলারও সে একই মর্যাদা। তবে একথা মুখে বলার উল্লেখ করা হয়েছেএজন্য যে, যাকে সাহায্য করা হবে তাকে যেন নিশ্চিত করা যায় যে,আমরা তার কাছে কোনো প্রকার কৃতজ্ঞতা অথবা বিনিময় চাই না, যাতে সে চিন্তামুক্ত হয়ে খাবার গ্রহণকরতে পারে।

সূরা দাহর আয়াত ১০-১১
অর্থাৎ চেহারার সজীবতা ও মনের আনন্দ। অন্য কথায় কিয়ামতের দিনের সমস্ত কঠোরতা ও ভয়াবহতা শুধু কাফেরদের জন্যই নির্দিষ্ট হবে। নেককার লোকেরা সেদিন কিয়ামতের সবরকম দুঃখ- কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে এবং আনন্দিত ও উৎফুল্ল হবে। একথাটিই সূরা আম্বিয়াতে এভাবে বলা হয়েছে ; “চরম হতবুদ্ধিকর সে অবস্থা তাদেরকে অস্থির ও বিহ্বল করবে না। ফেরেশতারা অগ্রসর হয়ে অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাদের গ্রহণ করবে এবং বলবে এটা তোমাদের সেদিন যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হতো।” (আয়াত, ১০৩) এ বিষয়টিই সূরা নামলে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে এভাবে : “যে ব্যক্তি সৎকাজ নিয়ে আসবে সে তার তুলনায় অধিক উত্তম প্রতিদান লাভ করবে। এসব লোক সেদিনের ভয়াবহতা থেকেও নিরাপদ থাকবে।” (আয়াত, ৮৯)

সূরা দাহর আয়াত-১২
এখানে ‘সবর’ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বরং প্রকৃতপক্ষে সৎকর্মশীল ঈমানদারদের গোটা পার্থিব জীবনকেই ‘সবর’ বা ধৈর্যের জীবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জ্ঞান হওয়ার বা ঈমান আনার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির নিজের অবৈধ আশা আকাঙ্খাকে অবদমিত করা, আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমাসমূহ মেনে চলা, আল্লাহর নির্ধারিত ফরযসমূহ পালন করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজের সময়, নিজের অর্থ-সম্পদ, নিজের শ্রম, নিজের শক্তি ও যোগ্যতা এমনকি প্রয়োজনের মুহূর্তে প্রাণ পর্যন্ত কুরবানী করা, আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়,

এরূপ সমস্ত লোভ-লালসা ও আকর্ষণকে পদাঘাত করা সত্য ও সঠিক পথে চলতে যেসব বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট আসে তা সহ্য করা, হারাম পন্থায় লাভ করা যায় এরূপ প্রতিটি স্বার্থ ও ভোগের উপকরণ পরিত্যাগ করা, ন্যায় ও সত্যপ্রীতির কারণে যে ক্ষতি, মর্মবেদনা ও দুঃখ-কষ্ট এসে ঘিরে ধরে তা বরদাশত করা—এসবই আল্লাহর এ ওয়াদার ওপর আস্থা রেখে করা যে, এ সদাচরণের সুফল এ পৃথিবীতে নয়, বরং মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবনে পাওয়া যাবে। এটা এমন একটা কর্মপন্থা যা মু’মিনের গোটা জীবনকেই সবরের জীবনে রূপান্তরিত করে। এটা সার্বক্ষণিক সবর, স্থায়ী সবর, সর্বাত্মক সবর এবং জীবনব্যাপী সবর।

সূরা দাহর আয়াত-১২-১৫
সূরা যুখরুফের ৭১ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদের সামনে সবসময় স্বর্ণপাত্রসমূহ পরিবেশিত হতে থাকবে। এ থেকে জানা গেল যে, সেখানে কোনো সময় স্বর্ণপাত্র এবং কোনো সময় রৌপ্য পাত্র ব্যবহার করা হবে।

সূরা দাহর আয়াত-১৫-১৬
অর্থাৎ তা হবে রৌপ্যের তৈরী কিন্তু কাঁচের মত স্বচ্ছ। এ ধরনের রৌপ্য এ পৃথিবীতে নেই । এটা জান্নাতের একটা বৈশিষ্ট যে, সেখানে কাঁচের মত স্বচ্চ রৌপ্যপাত্র জান্নাতবাসীদের দস্তরখানে পরিবেশন করা হবে।

অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার চাহিদা অনুপাতে পানপাত্র ভরে ভরে দেয়া হবে। তা তাদের চাহিদার চেয়ে কমও হবে না আবার বেশীও হবে না। অন্য কথায়, জান্নাতের খাদেমরা এত সতর্ক এবং সুবিবেচক হবে যে, যাকে তারা পানপাত্র পরিবেশন করবে সে কি পরিমাণ শরাব পান করতে চায় সে সম্পর্কে তারা পুরোপুরি আন্দাজ করতে পারবে।

সূরা দাহর আয়াত-১৭-১৮
আরবরা শরাবের সাথে শুকনো আদা মেশানো পানির সংমিশ্রণ খুব পছন্দ করতো। তাই বলা হয়েছে সেখানেও তাদের এমন শরাব পরিবেশন করা হবে যাতে শুকনো আদার সংমিশ্রণ থাকবে। কিন্তু তা এমন সংমিশ্রণ হবে না যে, তার মধ্যে শুকনো আদা মিশিয়ে তারপর পানি দেয়া হবে। বরং তা হবে একটা প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা যার মধ্যে আদার খোশবু থাকবে কিন্তু তিক্ততা থাকবে না। সেজন্য তার নাম হবে ‘সালসাবীল’। ‘সালসাবীল’ অৰ্থ এমন পানি যা মিঠা, মৃদু ও সুস্বাদু হওয়ার কারণে সহজেই গলার নীচে নেমে যায়। অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে ‘সালসাবীল’ শব্দটি এখানে উক্ত ঝর্ণাধারার বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ্য হিসেবে নয় ।

সূরা দাহর আয়াত-২০
অর্থাৎ দুনিয়াতে কোনো ব্যক্তি যত দরিদ্র ও নিসম্বলই হোক না কেন সে যখন তার নেক কাজেরকারণে জান্নাতে যাবে তখন সেখানে এমন শানশওকত ও মর্যাদার সাথে থাকবে যেন সে এক বিশালসাম্রাজ্যের অধিপতি।

সূরা দাহর আয়াত-২১
এই একই বিষয় সূরা আল কাহফের ৩১ আয়াতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে : ويلبسون ثيابا خضرا من سندس واستبرق متكئين فيها على الأرائك – “তারা (অর্থাৎ জান্নাতবাসীরা) মিহি রেশম এবং মখমল ও কিংখাবের সবুজ পোশাক পরিধান করবে। সুউচ্চ আসনে হেলান দিয়ে বসবে।”

এ কারণে সেসব মুফাসসিরদের মতামত সঠিক বলে মনে হয় না যারা বলেন, এর অর্থ এমন কাপড় যা তাদের আসন ও পালংকের ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে অথবা সেসব কিশোর বালকদের পোশাক- পরিচ্ছদ যারা তাদের সেবা ও খেদমতের জন্য সদা তৎপর থাকবে।

সূরা আল কাহফের ৩১ আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের সেখানে স্বর্ণের কংকন বা চুড়ি দ্বারা সজ্জিত ও শোভিত করা হবে।” এ একই বিষয় সূরা হজ্জের ২৩ আয়াত এবং সূরা ফাতেরের ৩৩ আয়াতেও বলা হয়েছে। এসব আয়াত একত্রে মিলিয়ে দেখলে তিনটি অবস্থা হওয়া সম্ভব বলে মনে হয়।

এক, তারা ইচ্ছা করলে কোনো সময় সোনার কংকন পরবে আবার ইচ্ছা করলে কোনো সময় রূপার কংকন পড়বে। তাদের ইচ্ছা অনুসারে দুটি’ জিনিসই প্রস্তুত থাকবে।

দুই, তারা সোনা ও রূপার কংকন এক সাথে পরবে। কারণ দু’টি একত্র করলে সৌন্দর্য অনেক বৃদ্ধি পায়।

তিন, যার ইচ্ছা সোনার কংকন পরিধান করবে এবং যার ইচ্ছা রূপার কংকন ব্যবহার করবে।

এখানে প্রশ্ন হলো, অলংকার পরিধান করে মেয়েরা, কিন্তু পুরুষদের অলংকার পরানোর অর্থ ও তাৎপর্য কি হতে পারে ? এর জবাব হলো, প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাহ এবং নেতা ও সমাজপতিদের রীতি ছিল তারা হাত, গলা ও মাথার মুকুটে নানা রকমের অলংকার ব্যবহার করতো। আমাদের এ যুগেও বৃটিশ ভারতের রাজা ও নবাবদের মধ্যে পর্যন্ত এ রীতি প্রচলিত ছিল। সূরা যুখরুফে বলা হয়েছে, হযরত মূসা আ. যখন সাদাসিধে পোশাকে শুধু একখানা লাঠি হাতে নিয়ে ফেরাউনের রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে তাকে বললেন যে,

তিনি বিশ্ব-জাহানের রব আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত রসূল তখন ফেরাউন তার সভাসদদের বললো ঃ সে এ অবস্থায় আমার সামনে এসেছে। দূত বটে— فلولا ألقى عليـه أسـورة مـن ذهب أوجاء معه المليك مقترنين “সে যদি জমিন ও আসমানের বাদশাহর পক্ষ থেকেই প্রেরিত হয়ে থাকতো তাহলে তার সোনার কংকন নাই কেন ? কিংবা ফেরেশতাদের একটি বাহিনী অন্তত তার আরদালী হয়ে আসতো।” (আয যুখরুফ, ৫৩ আয়াত)

ইতিপূর্বে দু’প্রকার শরাবের কথা বলা হয়েছে। এর এক প্রকার শরাবের মধ্যে কর্পূরের সুগন্ধি যুক্ত ঝর্ণার পানির সংমিশ্রণ থাকবে । অন্য প্রকারের শরাবের মধ্যে ‘যানজাবীল’ ঝর্ণার পানির সংমিশ্রণ থাকবে । এদু’প্রকার শরাবের কথা বলার পর এখানে আবার আর একটি শরাবের উল্লেখ করা এবং সাথে সাথে একথা বলা যে, তাদের রব তাদেরকে অত্যন্ত পবিত্র শরাব পান করাবেন, এর অর্থ এই যে, এটা কোনো প্রকার উৎকৃষ্টতর শরাব হবে যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে তাদের পান করানো হবে।

সূরা দাহর আয়াত-২২
মূল বাক্য হলো, كَانَ سَعْيُكُم مَّشْكُورًا এ অর্থাৎ তোমাদের কাজ-কর্ম মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছে। سعي অর্থ বান্দা সারা জীবনদুনিয়াতে যেসব কাজ-কর্ম আঞ্জাম দিয়েছে বা দেয় তা সবই।যেসব কাজে সে শ্রম দিয়েছে এবং যেসব লক্ষ্যে সে চেষ্টা-সাধনা করেছে তার সমষ্টি হলো তার سعي আর তা মূল্যবান প্রমাণিত হওয়ার অর্থ হলো আল্লাহ তা’আলার কাছে তা মূল্যবান বলে স্বীকৃত হয়েছে।শোকরিয়া কথাটি যখন বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর জন্য হয় তখন অর্থ হয় তাঁর নিয়ামতের জন্যকৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। আর যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য হয় তখন তার অর্থ হয় আল্লাহতা’আলা তার কাজ-কর্মের মূল্য দিয়েছেন। এটি মনিব বা প্রভুর একটি বড় মেহেরবানী যে, বান্দা যখনতাঁর মর্জি অনুসারে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য আঞ্জাম দেয় মনিব তখন তার মূল্য দেন বা স্বীকৃতি দেন।

সূরা দাহর আয়াত-২৩
এখানে বাহ্যত নবী সা.-কে সম্বোধন করা হলেও বক্তব্যের মূল লক্ষ কাফেররা। মক্কার কাফেররা বলতো, এ কুরআন মুহাম্মদ সা. নিজে চিন্তা-ভাবনা করে রচনা করেছেন। অন্যথায় আল্লাহ তা’আলারপক্ষ থেকে কোনো ফরমান এলে তা একবারেই এসে যেতো। কুরআনে কোনো কোনো জায়গায় তাদেরএ অভিযোগ উদ্ধৃত করে তার জবাব দেয়া হয়েছে। এখানে তাদের অভিযোগ উদ্ধৃতনা করেই আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করেছেন যে, কুরআনের নাযিলকারী আমি নিজেই ।অর্থাৎ মুহাম্মদ সা.-এর রচয়িতা নন। আমি নিজেই তা ক্রমান্বয়ে নাযিল করছি। অর্থাৎ আমার প্রজ্ঞা ওবিচক্ষণতার দাবী হলো, আমার বাণীকে একই সাথে একটি গ্রন্থের আকারে নাযিল না করে অল্প অল্পকরে নাযিল করা।

সূরা দাহর আয়াত-২৪
অর্থাৎ তোমার ‘রব’ তোমাকে যে বিরাট কাজ আঞ্জাম দেয়ার আদেশ দিয়েছেন তা আঞ্জাম দেয়ারপথে যে দুঃখ-যাতনা ও বিপদ-মুসিবত আসবে তার জন্য ‘সবর’ করো। যাই ঘটুক না কেন সাহস ও দৃঢ়তারসাথে তা বরদাশত করতে থাকো এবং এ দৃঢ়তা ও সাহসিকতায় যেন কোনো বিচ্যুতি আসতে না পারে।

অর্থাৎ তাদের কারো চাপে পড়ে দীনে হকের প্রচার ও প্রসারের কাজ থেকে বিরত হয়ো না এবংকোনো দুষ্কর্মশীলের কারণে দীনের নৈতিক শিক্ষায় কিংবা সত্য অস্বীকারকারীর কারণে দীনের আকীদা-বিশ্বাসে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করতেও প্রস্তুত হয়ো না। যা হারাম ও নাজায়েয তাকে খোলাখুলি হারাম ওনাজায়েয বলো, এর সমালোচনার ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় হওয়ার জন্য কোনো দুষ্কর্মশীল যতই চাপদিক না কেন। যেসব আকীদা-বিশ্বাস বাতিল তাকে খোলাখুলি বাতিল বলে ঘোষণা করো। আর যাহক তাকে প্রকাশ্যে হক বলে ঘোষণা করো, এ ক্ষেত্রে কাফেররা তোমার মুখ বন্ধ করার জন্য কিংবা এব্যাপারে কিছুটা নমনীয়তা দেখানোর জন্য তোমার ওপর যত চাপই প্রয়োগ করুক না কেন।

সূরা দাহর আয়াত-২৫-২৬
কুরআনের প্রতিষ্ঠিত রীতি হলো যেখানেই কাফেরদের মোকাবিলায় ধৈর্য ও দৃঢ়তা দেখানোরউপদেশ দেয়া হয়েছে সেখানে এর পরপরই আল্লাহকে স্বরণ করার ও নামাযের হুকুম দেয়া হয়েছে। এথেকে আপনা আপনি প্রকাশ পায় যে, সত্য দীনের পথে সত্যের দুশমনদের বাধার মোকাবিলা করার জন্যযে শক্তির প্রয়োজন তা এভাবেই অর্জিত হয়। সকাল ও সন্ধ্যায় আল্লাহকে স্মরণ করার অর্থ সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করাও হতে পারে। তবে সময় নির্দিষ্ট করে যখন আল্লাহকে স্মরণ করার হুকুম দেয়া হয়তখন তার অর্থ হয় নামায । এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম বলেছেনঃ وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ بُكْرَةً وَأَصِيلًا, আরবী ভাষায় بكرة – শব্দের অর্থ সকাল ।

আর أصيل শব্দটি সূর্য মাথার ওপর থেকে হেলেপড়ার সময় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় বুঝাতে ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে যোহর এবং আসরের সময়ওশামিল । এরপরে বলেছেন, وَمِنَ اللَّيْلِ فَاسْجُدْ রাত শুরু হয় সূর্যাস্তের পরে। তাই রাতের বেলাসিজদা করার নির্দেশের মধ্যে মাগরিব এবং ‘ঈশার দু’ওয়াক্তের নামাযই অন্তরভুক্ত হয়ে যায়। এর পরেরকথাটি “রাতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁর তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা কর” তাহাজ্জুদ নামাযের প্রতিস্পষ্টভাবে ইংগিত করে। ) এ থেকে একথাও জানা গেল যে, ইসলামে প্রথম থেকে এগুলোই ছিলনামাযের সময়। তবে সময় ও রাকআত নির্দিষ্ট করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার হুকুম দেয়াহয়েছে মে’রাজের সময় ।

সূরা দাহর আয়াত-২৭
অর্থাৎ কুরাইশ গোত্রের এসব কাফেররা যে কারণে আখলাক ও আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে গোমরাহীকে আঁকড়ে ধরে থাকতে আগ্রহী এবং তাদের কান নবী সা.-এর ‘দাওয়াতে হক’ বা সত্যেরআহ্বানের প্রতি অমনোযোগী, প্রকৃতপক্ষে সে কারণ হলো, তাদের দুনিয়া পূজা, আখেরাত সম্পর্কেনিরুদ্বিগ্নতা, উদাসীনতা ও বেপরোয়া ভাব। তাই একজন সত্যিকার আল্লাহভীরু মানুষের পথ এবংএদের পথ এতটা ভিন্ন যে, এ দু’টি পথের মধ্যে সমঝোতার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।

সূরা দাহর আয়াত-২৮
মূল বাক্য হলো, إِذَا شِئْنَا بَدَّلْنَا أَمْثَالَهُمْ تَبْدِيلًا । এ আয়াতাংশের কয়েকটি অর্থ হতেপারে। একটি অর্থ হতে পারে যখনই ইচ্ছা আমি তাদের ধ্বংস করে তাদের স্থলে অন্য মানুষদের নিয়েআসতে পারি, যারা তাদের কাজ-কর্ম ও আচার-আচরণে এদের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির হবে। এর দ্বিতীয়অর্থ হতে পারে, যখনই ইচ্ছা আমি এদের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে দিতে পারি। অর্থাৎ আমিযেমন কাউকে সুস্থ ও নিখুত অংগ-প্রত্যংগের অধিকারী করে সৃষ্টি করতে সক্ষম তেমনি কাউকেপুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিতে এবং কাউকে আংশিক পক্ষাঘাতের দ্বারা মুখ বাঁকা করে দিতে আবারকাউকে কোনো রোগ বা দুর্ঘটনার শিকার বানিয়ে পংগু করে দিতেও সক্ষম। তৃতীয় অর্থ হলো, যখনইইচ্ছা মৃত্যুর পর আমি এদেরকে পুনরায় অন্য কোনো আকার আকৃতিতে সৃষ্টি করতে পারি।

সূরা দাহর আয়াত-২৯-৩০
এ আয়াতগুলোতে তিনটি কথা বলা হয়েছে। এক, কেউ চাইলে তার রবের দিকে যাওয়ার পথ অবলম্বন করতে পারে। দুই, যদি আল্লাহ না চান তাহলে শুধু তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না। তিন, আল্লাহ অত্যন্ত কুশলী, সূক্ষ্মদর্শী ও মহাজ্ঞানী। এ তিনটি কথা সম্পর্কে যদি ভালোভাবে চিন্তা করা যায় তাহলে মানুষের বাছাই বা পছন্দ করার স্বাধীনতা এবং আল্লাহর ইচ্ছার মধ্যকার সম্পর্ক খুব ভালোভাবেই বুঝা যায় এবং তাকদীর সম্পর্কে মানুষের মনে যেসব জটিলতা দেখা যায় তা পরিষ্কার হয়ে যায় ।

প্রথম আয়াত থেকে জানা যায় যে, এ পৃথিবীতে মানুষকে যে ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তা শুধু এতটুকু যে এখানে জীবনযাপনের জন্য যেসব ভিন্ন ভিন্ন পথ তার সামনে আসে সে তার মধ্য থেকে কোনো একটি পথ অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নেবে। গ্রহণ বা বাছাই করার এরূপ অনেক স্বাধীনতা (Freedom of Choice) আল্লাহ তা’আলা তাকে দিয়েছেন। যেমন, এক ব্যক্তির সামনে যখন তার জীবিকা উপার্জনের প্রশ্ন দেখা দেয় তখন তার সামনে অনেকগুলো পথ থাকে। এসব পথের মধ্যে কিছু সংখ্যক থাকে হালাল পথ। যেমন, সবরকম বৈধ শ্রমকর্ম, চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, অথবা শিল্প ও কারিগরি কিংবা কৃষি ।

আবার কিছু সংখ্যক থাকে হারাম পথ। যেমন, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, পকেট মারা, ব্যভিচার, সুদখোরী, জুয়া, ঘুষ এবং হারাম প্রকৃতির সবরকম চাকুরী-বাকুরী ও ব্যবসায়- বাণিজ্য ইত্যাদি। এসব পথের মধ্য থেকে কোন পথটি সে বেছে নেবে এবং কিভাবে সে তার জীবিকা উপার্জন করতে চায় সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইখতিয়ার মানুষকেই দেয়া হয়েছে। অনুরূপ নৈতিক চরিত্রেরও বিভিন্ন ঢং বা প্রকৃতি আছে। এক দিকে আছে দীনদারী, আমানতদারী, ভদ্রতা, শিষ্টাচার, ইনসাফ, দয়ামায়া, সমবেদনা এবং সতীত্ব ও পবিত্রতার মত উন্নত স্বভাব ও গুণাবলী ।

অন্যদিকে আছে বদমাইশী, নীচতা-জুলুম-অত্যাচার, বেঈমানী, বখাটেপনা, বেহুদাপনা ও অভদ্রতার মত হীন স্বভাবসমূহ। এর মধ্য থেকে যে ঢং ও প্রকৃতির নৈতিক চরিত্রের পথ বা দোষ-গুণ সে অবলম্বন করতে চায় তা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তার আছে। আদর্শ ও ধর্মের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এ ক্ষেত্রেও মানুষের সামনে বহু পথ খোলা আছে । নাস্তিকতা তথা আল্লাহকে অস্বীকার করা, শির্ক ও মূর্তিপূজা, শির্ক ও তওহীদের বিভিন্ন সংমিশ্রণ এবং আল্লাহর আনুগত্যের একমাত্র নিখাদ ধর্ম কুরআন যার শিক্ষা দেয়। এর মধ্যেও মানুষ কোনটিকে গ্রহণ করতে চায় সে সিদ্ধান্ত নেয়ার ইখতিয়ার মানুষের হাতেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

আল্লাহ তা’আলা জোর করে তার ওপরে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না যে, সে নিজে হালাল রুজি খেতে চায় কিন্তু আল্লাহ তাকে হারামখোর হতে বাধ্য করছেন অথবা সে কুরআনের অনুসরণ করতে চায় কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাকে জোরপূর্বক নাস্তিক, মুশরিক অথবা কাফের বানিয়ে দিচ্ছেন। অথবা সে চায় সৎ মানুষ হতে কিন্তু আল্লাহ খামখা তাকে অসৎ বানিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু পছন্দ ও নির্বাচনের এ স্বাধীনতার পরেও মানুষের যা ইচ্ছা তাই করতে পারা আল্লাহর ইচ্ছা, তার অনুমোদন ও তাওফীক দানের ওপর নির্ভর করে। মানুষ যে কাজ করার আকাংখা, ইচ্ছা বা সংকল্প করেছে তা মানুষকে করতে দেয়ার ইচ্ছা যদি আল্লাহর থাকে তবেই সে তা করতে পারে।

অন্যথায় সে যত চেষ্টাই করুক না কেন আল্লাহর অনুমোদন ও তার ইচ্ছা ছাড়া সে কিছুই করতে সক্ষম নয়। দ্বিতীয় আয়াতে একথাটিই বলা হয়েছে। এ ব্যাপারটিকে এভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন যে, দুনিয়ার সব মানুষকে যদি সব ক্ষমতা ও ইখতিয়ার দিয়ে দেয়া হতো আর এ বিষয়টিও তার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া হতো যে, সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে তাহলে সারা দুনিয়ার সব ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম-শৃংখলা ধ্বংস এবং ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতো। যাকে ইচ্ছা হত্যা করার অবাধ স্বাধীনতা পেলে একজন হত্যাকারীই সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

একজন পকেটমারের যদি এ ক্ষমতা থাকতো যে, যার পকেট ইচ্ছা সে মারতে পারবে তাহলে পৃথিবীর কোনো মানুষের পকেটই তার হাত থেকে রক্ষা পেতো না। কোনো চোরের হাত থেকে কারো সম্পদ রক্ষা পেতো না, কোনো ব্যভিচারীর হাত থেকে কোনো নারীর সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষা পেতো না এবং কোনো ডাকাতের হাত থেকে কারো বাড়ী-ঘর রক্ষা পেতো না, যদি এদের সবারই যথেচ্ছাচারের পূর্ণ ইখতিয়ার বা ক্ষমতা থাকতো।

তাই মানুষ ন্যায় বা অন্যায় যে পথেই চলতে ইচ্ছা করুক না কেন সে পথে চলতে দেয়া না দেয়ার বিষয়টি আল্লাহ নিজের হাতেই রেখে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি গোমরাহীর পথ বর্জন করে সত্যের পথ অবলম্বন করতে চায় আল্লাহর ইচ্ছা এবং তাওফীক লাভ করেই কেবল সে সত্য পথে চলার সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো, গোমরাহীকে বর্জন করে হিদায়াতকে বাছাই ও গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত খোদ মানুষকেই নিতে হবে। তা না হলে আল্লাহ তা’আলা জোরপূর্বক যেমন কাউকে চোর, খুনী, নাস্তিক বা মুশরিক বানান না তেমনি জোরপূর্বক তাকে ঈমানদারও বানান না।

অতপর তৃতীয় আয়াতে এ ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলার এ ইচ্ছা আবার নিয়ম-বিধি মুক্ত স্বেচ্ছাচারমূলক (Arbitrary) ব্যাপার কিনা এ ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা عليم এবং حكيم অর্থাৎ তিনি সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী, তেমনি অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী, কুশলী ও প্রজ্ঞাময় । তিনি যা কিছু করেন জ্ঞান ও বিজ্ঞতার সাথেই করেন। তাই তাঁর সিদ্ধান্তে ভুল-ত্রুটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাকে কি ‘তাওফীক’ দিতে হবে এবং কি দিতে হবে না,কাকে কি কাজ করতে দেয়া উচিত আর কাকে দেয়া উচিত নয় সে সিদ্ধান্ত তিনি পূর্ণ জ্ঞান এবং যুক্তি ওকৌশলের ভিত্তিতে গ্রহণ করেন।

মানুষকে তিনি যতটা অবকাশ দেন এবং উপায়-উপকরণকেও যতটাতার অনুকূল করে দেন ভালো হোক বা মন্দ হোক মানুষ নিজের ইচ্ছানুসারে ঠিক ততটা কাজই করতেপারে। হিদায়াত লাভের ব্যাপারটাও এ নিয়মের বাইরে নয়। কে হিদায়াতের উপযুক্ত আর কে নয়নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ তা’আলা তা জানেন এবং নিজের যুক্তি ও কৌশলের ভিত্তিতে সে বিষয়েসিদ্ধান্ত গ্রহণও তিনিই করে থাকেন।

সূরা দাহর আয়াত-৩১
এ আয়াতে জালেম বলে সেসব লোককে বুঝানো হয়েছে যাদের কাছে আল্লাহর বাণী এবং তাঁর নবীর শিক্ষা আসার পর তারা অনেক চিন্তা-ভাবনা ও বিচার বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, তাঁর আনুগত্য তারা করবে না। এর মধ্যে সেসব জালেমও আছে যারা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে আমরা এ বাণীকে আল্লাহর বাণী এবং এ নবীকে আল্লাহর নবী বলে মানি না। অথবা আল্লাহকেই আদৌ মানি না। আবার সেসব জালেমও আছে যারা আল্লাহ, নবী ও কুরআনকে মানতে অস্বীকার করে না বটে কিন্তু সিদ্ধান্ত তাদের এটাই থাকে যে, তাঁরা তার আনুগত্য করবে না। প্রকৃতপক্ষে এ দু’টি গোষ্ঠীই জালেম।

প্রথম গোষ্ঠীর ব্যাপারটা তো স্পষ্ট। কিন্তু দ্বিতীয় গোষ্ঠীও তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম জালেম নয়। বরং জালেম হওয়ার সাথে সাথে তারা মুনাফিক এবং প্রতারকও। তারা মুখে বলে, আমরা আল্লাহকে মানি, কুরআনকে মানি। কিন্তু তাদের মন ও মগজের ফয়সালা হলো, তার অনুসরণ তারা করবে না। আর তারা কাজও করে এর পরিপন্থী। এ দু’শ্রেণীর মানুষ সম্পর্কেই আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা হলো, আমি তাদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। দুনিয়াতে তারা যতই নির্ভীক ও বেপরোয়া চলুক, আরাম আয়েশে বিভোর থাকুক এবং নিজের বাহাদুরীর ডংকা বাজাক না কেন অবশেষে তাদের পরিণাম কঠোর শাস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহর রহমতের মধ্যে প্রবেশ করা তাদের ভাগ্যলিপিতেই নেই ।

আরো পড়ুন :

৭৭.সূরা মুরসালাত Surah Mursalat سورة المرسلات এর তাফসির ও শানে নুযুল

৭৯.সূরা নাযিয়াত سورة النازعات Surah An Naziat এর তাফসির ও শানে নুযুল

৮০.সূরা আবাসা سورة عبس Surah Abasa এর তাফসির ও শানে নুযুল

৮১.সূরা আত তাকভীর سورة التكوير Surah At Takwir এর তাফসির ও শানে নুযুল

ট্যাগ সমূহ : সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর আয়াত ৮,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর এর ফজিলত, surah dahr,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর এর ফজিলত,সূরা আদ-দাহর বাংলা অনুবাদ,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর আয়াত ১৫,surah a dukhan,সূরা আদ দাহর,সূরা দাহার, দাহর অর্থ কি, সূরা দাহর এর শানে নুযুল, সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা আদ দাহর,সূরা আদ-দাহর বাংলা অনুবাদ,সূরা দাহর,فوائد سورة الدَّهْرِ,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,,সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর আয়াত ৮,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর এর ফজিলত, surah dahr,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর এর ফজিলত,সূরা আদ-দাহর বাংলা অনুবাদ,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর আয়াত ১৫,surah a dukhan,সূরা আদ দাহর,সূরা দাহার, দাহর অর্থ কি, সূরা দাহর এর শানে নুযুল, সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা আদ দাহর,সূরা আদ-দাহর বাংলা অনুবাদ,সূরা দাহর,فوائد سورة الدَّهْرِ,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর ফজিলত,সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর এর শানে নুযুল,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর ফজিলত,সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর এর শানে নুযুল,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর ফজিলত,সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর এর শানে নুযুল,সূরা দাহর,সূরা দাহর এর ফজিলত,সূরা দাহর বাংলা উচ্চারণ,সূরা দাহর এর তাফসীর,সূরা দাহর এর শানে নুযুল


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top