০১. সূরা ফাতিহা এর তাফসীর নামকরন ও শানে-নুযূল

সূরা ফাতিহা سورة الفاتحة Surah Fatiha এর তাফসির ও শানে নুযুল

সূরা ফাতিহা এর পরিচয়

সূরার নাম : সূরা আল ফাতিহা।সূরার অর্থ : শুরু।
সূরা নং : ১রুকু সংখ্যা : ১
আয়াত সংখ্যা : ৭সিজদা সংখ্যা : ০
শব্দ সংখ্যা : ২৫পারার সংখ্যা : ১
অক্ষর সংখ্যা : ১১৩শ্রেণী : মাক্কী।

নামকরণ :

ইমাম বুখারী (রহ:) বলেন, সূরা ফাতিহা এর নাম উম্মুল কিতাব এজন্য রাখা হয়েছে যে, এ সূরার মাধ্যমেই পবিত্র কোরআন এর সংকলন কার্য শুরু করা হয়েছে এবং এই সূরা পাঠের মাধ্যমে সালাত শুরু করা হয়ে থাকে। আরবরা প্রত্যেক বস্তুর উৎস সারগর্ভ বস্তু বা কোন কাজের অগ্রভাগ যার অনুগামী শাখা-প্রশাখা সমূহ রয়েছে তাকে উম্মু বলে। যেমন মক্কাকে উম্মুল‌ ক্বোরা বলা হয়। পৃথিবীর প্রথম ও শীর্ষ মর্যাদাবান নগরী হওয়ার কারণে এবং এটাই পৃথিবীর নাভী মূল ও এখান থেকে পৃথিবীর বিস্তার লাভ করেছে । [ইবনু জারীর,কুতুবী, ইবনূ কাছীর]

অতএব সুরা ফাতিহাকে উম্মুল কোরআন এজন্য বলা হয়েছে যে, এটা দিয়ে কোরআন শুরু হয়েছে এবং এর মধ্যে কোরআনের সমস্ত ইলম শামিল রয়েছে। (কুরতুবী)

সূরা ফাতিহা এর নাম সমূহ :

বিভিন্ন হাদিস, আছার ও বিদ্বানগণ সূরা ফাতিহা এর নামকরণের মাধ্যমে ৩০ টি নাম বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে সহিহ হাদিস সমূহে এসেছে ৮ টি। যেমন, (১) উম্মুল কোরআন (কোরআনের মূল)। (২) উম্মুল কিতাব। (৩) আস-সাব’উল মাছানি। (৪) আল কোরআনুল আজীম। (৫) আল হামদু। (৬) সালাত। (৭) রুকিয়াহ। (৮) ফতিহাতুল কিতাব।

এবং অন্য নামগুলি যেমন : (৯) শিফা। (১০) আসাসুল কোরআন। (১১) কাফিয়াহ (১২) ওয়াফিয়াহ (১৩) সূরা ওয়াকিয়াহ (১৪) কাণ্য (খনি)। এছাড়াও ফাতেহাতুল কোরআন, সুরাতুল হামদ, শুক্র, ফাতিহহা, মিন্নাহ, দো’আ, সওয়াল, মোনাজাত , তাফভীয, মাসআলা, রা:কিয়াহ, নুর,আল – হামদুলিল্লাহ, ইল্লুল ইয়াকীন, সুরাতুল হামদিল উলা, সুরতুল হামদীল কুছরা। এইভাবে নাম বৃদ্ধির ফলে সুরা ফাতিহার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।

অবতরণকাল :

সর্বপ্রথম সূরা আলাক এর প্রথম পাঁচ আয়াত মক্কা নাযিল হয়। এরপর কয়েকদিন ওহীর বিরতিকাল শেষে সূরা মুদ্দাসসির এর প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়। অন্য বর্ণনায় সাতটি আয়াতের কথা বলা হয়েছে। তারপরে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে সূরা ফাতিহা নাজিল হয়।

সূরা ফাতিহা سورة الفاتحة Surah Fatiha এর তাফসির ও শানে নুযুল


بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

শুরু করছি আল্লাহ তা’আলার নামে, যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু ।

(١) الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

উচ্চারণ : আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল ‘আ -লামি-ন।

(১) যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার, যিনি সকল সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা।

(٢) الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ

উচ্চারণ : আররহমা-নির রাহি-ম।

(২) যিনি পরম করুণাময় অতি দয়ালু।

(٣) مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ

উচ্চারণ : মা-লিকি ইয়াওমিদ্দি-ন।

(৩) যিনি বিচারদিনের মালিক।

(٤) إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

উচ্চারণ : ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কা নাসতাঈ’-ন

(৪) আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি ।

(٥) اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

উচ্চারণ : ইহদিনাস সিরা-তাল মুসতাকিম

(৫) আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।

(٦) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ

উচ্চারণ : সিরা-তাল্লা যিনা আনআ’মতা আ’লাইহিম

(৬) সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নিয়ামত দান করেছ।

(٧) غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ

উচ্চারণ : গাইরিল মাগদুবি আ’লাইহিম ওয়ালা দ্দ-ল্লি-ন।

(৭) তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

সূরা ফাতিহা سورة الفاتحة Surah Fatiha এর তাফসির ও শানে নুযুল

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ -(১:১)

উচ্চারণ : বিসমিল্লাহির রহমা-নির রহি-ম।

অনুবাদ : শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

তাফসীর আয়াত (১:১) :

(১) রহমান রহিম ও আল্লাহর নামে।

(২) অনন্ত করুনাময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করিতেছি।

বিসমিল্লাহ’র পূর্বে একটি ফে’ল (ক্রিয়া) উহ্য আছে। অর্থাৎ, আল্লাহর নাম নিয়ে পড়ছি অথবা শুরু করছি কিংবা তেলাওয়াত আরম্ভ করছি। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আরম্ভ করার পূর্বে বিসমিল্লাহ পড়ার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে। সুতরাং নির্দেশ করা হয়েছে যে, খাওয়া, জবেহ করা, ওযু করা এবং সহবাস করার পূর্বে বিসমিল্লাহ পড়। অবশ্য কোরআন তেলাওয়াত করার সময় “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” পড়ার পূর্বে “আউযুবিল্লাহি মিনাশশায়ত্বানির রাজীম” পড়াও অত্যাবশ্যক।

মহান আল্লাহ বলেছেন, “অতএব তুমি যখন কোরআন পাঠ করবে তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর।” (সূরা-নাহল, আয়াত : ৯৮)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম যে কোন ভালো কাজ শুরু করার প্রথমে বিসমিল্লাহ বলার নির্দেশ দিতেন। যেমন, খাবার খেতে। [ বুখারী : ৫৩৭৬, মুসলিম : ২০১৭, ২০২২]

এছাড়াও দরজা বন্ধ করতে, আলো নিভাতে, পাত্র ঢাকতে, পাত্র বন্ধ করতে বিসমিল্লাহ বলতেন। [বুখারী : ৩২৮০]

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ -(১:২)

উচ্চারণ : আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আ -লামি-ন।

অনুবাদ : যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।

তাফসীর আয়াত (১:২) :

সকল প্রশংসা সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।

আরবি ভাষায় হামদ অর্থ প্রশংসা। গুণ ও সিফাত সাধারণত: দুই প্রকার হয়ে থাকে। তা ভালো হয় আবার মন্দও হয়। কিন্তু হামদ শব্দটি কেবলমাত্র ভালো গুণ প্রকাশ করে। অর্থাৎ বিশ্ব জাহানের যা কিছু এবং যত কিছু ভালো, সৌন্দর্য-মাধুর্য, পূর্ণতা মহাত্মা দান ও অনুগ্রহ রয়েছে তা সেখানেই এবং যেকোনো রূপে ও যে কোন অবস্থায় থাকুক না কেন তা সবই একমাত্র আল্লাহ তাআলার ওই জন্য নির্দিষ্ট। একমাত্র তিনিই-তার মহান সত্তাই যেসব পাওয়ার অধিকারী। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য এর যোগ্য হতে পারে না। কেননা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনিই এবং তার সব সৃষ্টি অতীব সুন্দর। এর অধিক সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। তার সৃষ্টি, লালন-পালন- সংরক্ষণ সাধারণের সৌন্দর্য তুলনাহীন।

তাই এর দরুন মানব মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠা প্রশংসা ও ইচ্ছামূলক প্রশংসাকে হামদ বলা হয়। এখানে এটা বিশেষভাবে জানা আবশ্যক যে, “আল-হামদু” কথাটি “আশ- শুকর” থেকে অনেক ব্যাপক, যা আধিক্য ও পরিপূর্ণতা বোঝায়। কেউ যদি কোন নেয়ামত পায় তাহলে সেই নেয়ামতদের জন্য শুকরিয়া প্রকাশ করা হয়। সে ব্যক্তি যদি কোন নেয়ামত না পায় (অথবা তার পরিবর্তে অন্য ব্যক্তি নিয়ামতটি পায়) স্বভাবত:ই তার বেলায় এজন্য শুকরিয়া নয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নেয়ামত পায়, সেই শুকরিয়া আদায় করে। যে ব্যক্তি নেয়ামত পায় না সে শুকরিয়া আদায় করে না। এ হিসাবে “আশ- শুকর লিল্লাহ” বলার অর্থ হতো এই যে, আমি আল্লাহর যে নিয়ামত পেয়েছি, সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।

অপরদিকে “আল-হামদুলিল্লাহ” অনেক ব্যাপক। এর সম্পর্ক শুধু নেয়ামত প্রাপ্তির সাথে নয়। আল্লাহর যত নেয়ামত আছে, তা পাওয়া যাক, না পাওয়া যাক; সেই নেয়ামত কোন ব্যক্তি পেল, নিজে পেল, বা অন্যরা পেল, সব কিছুর জন্যই যে প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য সেটিই হচ্ছে হামদ [ইবনে – কাসীর]

এজন্য হাদিসে বলা হয়েছে “সর্বোত্তম দোয়া হলো আলহামদুলিল্লাহ” [তিরমিযী: ৩৩৮৩] কারণ তা সর্বকাল ব্যাপী। অন্য হাদিসে এসেছে রাসূল সাঃ বলেছেনঃ “আলহামদুলিল্লাহ” মীজান পূর্ণ করে।[মুসলিম :২২৩] অধিকাংশ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিন-রাত্রির জিকির ও সালাতের পরের জিকির এর মধ্যে আলহামদুলিল্লাহ শব্দের শিখিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ হলো সীমাহীন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার রূপ।

রব :

মহান আল্লাহর সুন্দর নাম সমূহের অন্যতম। যার অর্থ হল প্রত্যেক সৃষ্টিকে সৃষ্টি করে তার প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করে তার পরিপূর্ণতা দানকারী। কোন জিনিসের প্রতি সম্বন্ধ (ইজাফত) না করে এর ব্যবহার অন্য কারো জন্য বৈধ নয়। ‘আলাম’ “আলামীন”(বিশ্ব-জাহান) শব্দের বহুবচন। তবে সকল সৃষ্টির সমষ্টিকে “আলাম” বলা হয়। এর জন্যই এর বহুবচন ব্যবহার হয় না। কিন্তু এখানে তার (আল্লাহর) পূর্ণ প্রতিপালকত্ব প্রকাশ করার জন্য এরও বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে।

এ থেকে উদ্দেশ্য হল, সৃষ্টির ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়। যেমন, জ্বীন সম্প্রদায়, মানুষ সম্প্রদায়, ফিরিস্তাকুল এবং জীবজন্তু ও পশু-পক্ষীকুল ইত্যাদি। এই সমস্ত সৃষ্টির প্রয়োজন সমূহ একে অপর থেকে অবশ্যই ভিন্নতর। কিন্তু বিশ্বের প্রতিপালক প্রত্যেকের অবস্থা, পরিস্থিতি এবং প্রকৃতি ও দেহ অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় জিনিসের বেবস্থা করে থাকেন। [তাফসীরে আহসানুল বায়ান]

الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ -(১:৩)

উচ্চারণ : আররহমা-নির রাহি-ম।

অনুবাদ : যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু।

তাফসীর আয়াত (১:৩) :

দয়াময়, পরম দয়ালু।

“রহমান – রাহিম” শব্দদ্বয়ের কারণে মূল আয়াতের অর্থ এই দাড়ায় যে,আল্লাহ তায়ালাই সমস্ত এবং সকল প্রকার প্রশংসা একচ্ছত্র অধিকারী কেবল এই জন্যই নয় যে তিনি রব্বুল আলামীন, বরং এই জন্যও যে তিনি “আর রহমান” ও “আর রাহিম” । বিশ্বের সর্বত্র আল্লাহ তায়ালার ওপর অসীম দয়া ও অনুগ্রহ প্রতিনিয়ত পরিবেশিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক জগতে এই যে নি:সীম শান্তি শৃংখলা ও সামঞ্জস্য সুবিন্নাস বিরাজিত রয়েছে, এর একমাত্র কারণ এই যে , আল্লাহর রহমত সাধারণভাবে সব কিছুর উপর অজস্র ধারায় বর্ষিত হয়েছে।

সকল শ্রেণীর সৃষ্টিই আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করেছে। কাফির, মুশরিক, আল্লাহদ্রোহী, নাস্তিক,মুনাফিক কাউ কেই আল্লাহ তার রহমত থেকে বঞ্চিত করেন নি। এমন কি আল্লাহর অবাধ্যতা ও বিরোধীতা করতে চাইলেও আল্লাহ নিজ হতে কাও কে বাধা প্রদান করেন নি। বরং তিনি মানুষ কে একটা সীমার মধ্যে যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ দিয়েছেন। এই জড় দুনিয়ার বেপারে এটাই আল্লাহর নিয়ম। এই জন্যই আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন ‘ “আর আমার রহমত সব কিছুকেই ব্যাপ্ত করে আছে।” [ সূরা:আল আরাফ, আয়াত-১৫৬] [তাফসীরে জাকারিয়া]

مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ -(১:৪)

উচ্চারণ : মা-লিকি ইয়াওমিদ্দি-ন।

অনুবাদ : বিচার দিনের একমাত্র অধিপতি।

তাফসীর আয়াত (১:৪) :

যিনি বিচার দিনের মালিক।

যদিও দুনিয়াতে কর্মের প্রতিদান দেওয়ার নীতি কোন না কোনো ভাবে চালু আছে, তবুও এর পূর্ণ বিকাশ ঘটবে আখিরাতে। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে তার ভালো ও মন্দ কর্মের অনুযায়ী পরিপূর্ণ প্রতিদান শান্তি ও শাস্তি প্রদান করবেন।অনুরূপ দুনিয়ায় অনেক মানুষ অল্প সময়ের জন্য কারণ-ঘটিত ক্ষমতা তো শক্তির মালিক হয়।কিন্তু আখিরাতের সমস্থ এখতিয়ার ও ক্ষমতার মালিক হবেন একমাত্র আল্লাহ।সেদিন তিনি বলবেন,”আজ রাজত্ব কার?” অতঃপর তিনিই উত্তর দিয়ে বলবেন,”পরাক্রমশালী একক আল্লাহর জন্য।”

(যেদিন কেউ কারও কোনো উপকার করতে পারবে না এবং সে দিন সকল কৃতিত্ব হবে আল্লাহর।) এটা হবে বিচার ও প্রতিদান দিবস। [তাফসিরে আহসানুল বয়ান]

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ -(১:৫)

উচ্চারণ : ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কা নাসতাই’-ন

অনুবাদ : আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

তাফসীর আয়াত (১:৫) :

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ -(১:৬)

উচ্চারণ : ইহদিনাস সিরাতা’ল মুসতাকি’-ম

অনুবাদ : আমাদের সরল পথ দেখাও।

তাফসীর আয়াত (১:৬) :

আমাদেরকে সরল পথ দেখাও

اهْدِنَا (হিদায়াত) শব্দের কয়েকটি অর্থ ব্যবহার হয়।যেমন, পথের দিক নির্দেশ করা, পথে পরিচালনা করা এবং গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দেওয়া। আরবিতে এটাকে ইরশাদ, তাওফিক্ব, ইলহাম এবং দালালাহ ইত্যাদি শব্দের আখ্যায়িত করা হয়। অর্থ হল, আমাদেরকে সঠিক পথের দিকে দিক নির্দেশ কর, এ পথে চলার তাওফিক দাও এবং এর উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো, যাতে আমরা তোমার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি। পরক্ষন্তে সরল সঠিক পথ কেবল জ্ঞান বুদ্ধি দ্বারা অর্জিত হয় না। এই সরল সঠিক পথ হল সেই ইসলাম যা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করেছেন এবং যা বর্তমানে কোরআন ও সহিহ হাদিসের মধ্যে সুরক্ষিত। [তাফসিরে আহসানুল বয়ান]

صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ -(১:৭)

উচ্চারণ : সিরাতা’ল্লা যি-না আনআ’মতা আ’লাইহিম গা’ইরিল মাগ’দু’বি আ’লাইহিম ওয়ালা দ্দ-ল্লি-ন।

অনুবাদ : তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন। যাদেরকে নিয়ামত দিয়েছেন।যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ আপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়। 

তাফসীর আয়াত (১:৭) :

৭. তাদের পথ, যাদেরকে আপনি নিয়ামত দিয়েছেন(১), যাদের উপর আপনার ক্রোধ আপতিত হয়নি(২) এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়।(৩)

১. এটা আল্লাহর নির্ধারিত সঠিক ও দৃঢ় পথের প্রথম পরিচয়। এর অর্থ এই যে, আল্লাহর নিকট হতে যে পথ নাযিল হয়েছে, তা অনুসরণ করলে আল্লাহর রহমত ও নিয়ামত লাভ করা যায়। দ্বিতীয়তঃ তা এমন কোন পথই নয়, যাহা আজ সম্পূর্ণ নূতনভাবে পেশ করা হচ্ছে- পূর্বে পেশ করা হয় নি। বরং তা অতিশয় আদিম ও চিরন্তন পথ। মানুষের এই কল্যাণের পথ অত্যন্ত পুরাতন, ততখানি পুরাতন যতখানি পুরাতন হচ্ছে স্বয়ং মানুষ। প্রথম মানুষ হতেই এটা মানুষের সম্মুখে পেশ করা হয়েছে, অসংখ্য মানুষ এ পথ প্রচার করেছেন, কবুল করার আহবান জানিয়েছেন, এটা বাস্তবায়িত করার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহর নিকট হতে, অপূর্ব নিয়ামত ও সম্মান লাভের অধিকারী প্রমাণিত হয়েছেন। এই নিয়ামত এই দুনিয়ার জীবনেও তারা পেয়েছেন, আর আখেরাতেও তা তাদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে।

মূলত: আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্ত লোকদের চলার পথ ও অনুসৃত জীবনই হচ্ছে বিশ্ব মানবতার জন্য একমাত্র পথ ও পন্থা। এতদ্ব্যতীত মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য, অনুসরণীয় ও কল্যাণকর পথ আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোক কারা এবং তাদের পথ বাস্তবিক পক্ষে কি? এর উত্তর অন্য আয়াতে এসেছে,

“যা করতে তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা তা করলে তাদের ভাল হত এবং চিত্তস্থিরতায় তারা দৃঢ়তর হত। এবং তখন আমি আমার কাছ থেকে তাদেরকে নিশ্চয় মহাপুরস্কার প্রদান করতাম এবং তাদেরকে নিশ্চয় সরল পথে পরিচালিত করতাম। আর কেউ আল্লাহ এবং রাসুলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ (যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন) তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী! এগুলো আল্লাহর অনুগ্রহ। সর্বজ্ঞ হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট [সূরা আন-নিসাঃ ৬৬-৭০)

এ আয়াত থেকে সঠিক ও দৃঢ় জীবন পথ যে কোনটি আর আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্ত লোকগণ যে কোন পথে চলেছেন ও চলে আল্লাহর অনুগ্রহ পাবার অধিকারী হয়েছেন তা সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে জানা যায়। তারা হচ্ছেন আম্বিয়া, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহীন। [ইবন কাসীর]

২. এটা আল্লাহর নির্ধারিত সিরাতুল মুস্তাকীম এর দ্বিতীয় পরিচয়। আল্লাহ তাআলা যে পথ মানুষের সম্মুখে চিরন্তন কল্যাণ লাভের জন্য উপস্থাপিত করেছেন সে পথ অভিশাপের পথ নয় এবং সে পথে যারা চলে তাদের উপর কখনই আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হতে পারে না। সে পথ তো রহমতের পথ বরং সে পথের পথিকদের প্রতি দুনিয়াতে যেমন আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য বর্ষিত হয়ে থাকে, আখেরাতেও তারা আল্লাহর চিরস্থায়ী সন্তোষ লাভের অধিকারী হবে।

এই আয়াতাংশের অপর একটি অনুবাদ হচ্ছে, “তাদের পথ নয় যাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ নাযিল হয়েছে।” এরূপ অনুবাদ করলে তাতে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ ছাড়া আরও একটি পথের ইঙ্গিত মানুষের সামনে উপস্থাপিত হয়, যা আল্লাহর নিকট হতে অভিশপ্ত এবং সেই পথ হতে মানুষকে রক্ষা করাই এর উদ্দেশ্য মনে হয়। কিন্তু এখানে আল্লাহ মূলতঃ একটি পথই উপস্থাপিত করেছেন এবং একটি পথেরই ইতিবাচক দুইটি বিশেষণ দ্বারা সেটাকে অত্যধিক সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। তাই অনেকেই পূর্বোক্ত প্রথম অনুবাদটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। [উভয় অর্থের জন্য দেখুন, যামাখশারী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

প্রথম অনুবাদ বা দ্বিতীয় অনুবাদ যাই হোক না কেন এখানে একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানদার লোকদেরকে প্রকারান্তরে এমন পথ ও পন্থা গ্রহণ হতে বিরত থাকবার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, যা আল্লাহর অভিশাপের পথ, যে পথে চলে কোন কোন লোক অভিশপ্ত হয়েছে।

কিন্তু সে অভিশপ্ত কারা, কারা কোন পথে চলে আল্লাহর নিকট হতে অভিশপ্ত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া আবশ্যক। কুরআন মজীদ ঐতিহাসিক জাতিদের সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছেঃ “আর তাদের উপর অপমান লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্যের কষাঘাত হানা হয়েছে এবং তারা আল্লাহর অভিশাপ প্রাপ্ত হয়েছে।[সূরা আল-বাকারাহ: ৬১] পূ

র্বাপর আলোচনা করলে নিঃসন্দেহে এটা বুঝতে পারা যায় যে, এ কথাটি ইয়াহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাই মাগদুব বলতে যে এখানে ইয়াহুদীদের বুঝানো হয়েছে, সে বিষয়ে সমস্ত মুফাসসিরই একমত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসেও অনুরুপ স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে [দেখুন, মুসনাদে আহমাদ ৫/৩২,৩৩]

৩. এটি সিরাতুল মুস্তাকীম’-এর তৃতীয় ও সর্বশেষ পরিচয়। অর্থাৎ যারা সিরাতুল মুস্তাকীম এ চলে আল্লাহর নিয়ামত লাভ করতে পেরেছেন তারা পথভ্রষ্ট নন-কোন গোমরাহীর পথে তারা চলেন না। পূর্বোল্লেখিত আয়াতের ন্যায় এ আয়াতেরও অন্য অনুবাদ হচ্ছে, তাদের পথে নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, যারা গোমরাহ হয়ে আল্লাহর উপস্থাপিত পথ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস থেকে এ পথ-ভ্ৰষ্ট লোকদের পরিচয় জানতে পারা যায় যে, দুনিয়ার ইতিহাসে নাসারাগণ হচ্ছে কুরআনে উল্লেখিত এ গোমরাহ ও পথ-ভ্ৰষ্ট জাতি। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩২,৩৩, ৭৭]

কোন মুসলিম যখন সূরা ফাতিহা পাঠ করে, তখন সে প্রকারান্তরে এ কথাই ঘোষণা করে যে, “হে আল্লাহ আমরা স্বীকার করি, আপনার সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে যে জীবন-ধারা গড়ে উঠে তা-ই একমাত্র মুক্তির পথ। এজন্য আপনার নির্ধারিত এ পথে চলে যারা আপনার নিয়ামত পেয়েছেন সেই পথই একমাত্র সত্য ও কল্যাণের পথ, আল্লাহ সেই পথেই আমাদেরকে চলবার তাওফীক দিন। আর যাদের উপর আপনার অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে ও যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের যেন আমরা অনুসরণ না করি।

কেননা, সে পথে প্রকৃতই কোন কল্যাণ নেই। বস্তুতঃ পবিত্র কুরআন দুনিয়ার বর্তমান বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ ও একমাত্র সর্বশেষ আল্লাহর দেয়া গ্রন্থ। এর উপস্থাপিত আদর্শ ও জীবন পথই হচ্ছে বিশ্বমানবতার একমাত্র স্থায়ী ও কল্যাণের পথ। এর বিপরীত সমস্ত জীবনাদর্শকে মিথ্যা প্রমাণ করে একমাত্র এরই উপস্থাপিত আদর্শের ভিত্তিতে নিজেদেরকে গঠন করা মুসলিমদের একমাত্র দায়িত্ব। মুসলিমরা আজও সেই দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ হলে সূরা আল ফাতিহা তাদের জীবনে সার্থক হবে।

মূলতঃ যারা সূরা আল-ফাতিহার অর্থ বুঝে সূরা আল-ফাতিহা পাঠ শেষ করার পর তাদের মন থেকে দোআ করবে, আল্লাহ তা’আলা তাদের দোআ কবুল করবেন। হাদীসে এসেছে, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, إِذَا قَالَ الْإِمَامُ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ فَمَنْ وَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ  “ইমাম গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদদ্বলীন বলে তখন তোমরা ‘আমীন’ বা ‘হে আল্লাহ কবুল কর’ একথাটি বল; কেননা যার কথাটি ফেরেশতাদের কথা অনুযায়ী হবে তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয় হবে” [বুখারী: ৭৮২, মুসলিম ৪০৯]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَإِذَا قَالَ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ يُجِبْكُمُ الله যখন ইমাম ‘গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বলীন’ বলে তখন তোমরা আমীন বা ‘হে আল্লাহ কবুল কর একথাটি বল; এতে আল্লাহ তোমাদের আহবানে সাড়া দিবেন (দোআ কবুল করবেন) [মুসলিম ৪০৪]

অন্য একহাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, مَا حَسَدَتْكُمْ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ ، مَا حَسَدَتْكُمْ عَلَى السَّلَامِ وَالتَّأْمِينِ “ইয়াহুদীরা তোমাদেরকে সালাম ও আমীন বলার চেয়ে বেশী কোন বিষয়ের উপর হিংসা করে না।” [ইবন মাজাহ: ৮৫৬]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top