সূরা নাস এর পরিচয় :
সূরা নং : ১১৪ | রুকু সংখ্যা : ১ |
সূরার নাম : সূরা নাস | সূরা অর্থ : মানব জাতি। |
আয়াত সংখ্যা : ৬ | সিজদা সংখ্যা : ০ |
শব্দ সংখ্যা : ২০ | শ্রেণী : মাদানী |
অক্ষর সংখ্যা : ৮০ | পারার সংখ্যা :৩০ |
সূরা নাস এর তাফীসর বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ
(১) বল! আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের পালনকর্তার।
مَلِكِ النَّاسِ
(২) মানুষের অধিপতির।
إِلَهِ النَّاسِ
(৩) মানুষের উপাস্যের।
مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ
(৪) গোপন কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হ’তে,
الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
(৫) যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তর সমূহে,
مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ
(৬) জ্বিনের মধ্য হ’তে ও মানুষের মধ্য হ’তে।
সূরা নাস এর বিষয়বস্তু :
প্রথমে তিনটি আয়াতে আল্লাহর তিনটি সিফাত বর্ণনা করে পরের তিনটি আয়াতে জিন ও মানবরুপী শয়তানের কুমন্ত্রণা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সূরা নাস এর তাফীসর
আয়াত (১-৩) قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ ,مَلِكِ النَّاسِ ,إِلَهِ النَّاسِ আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের পালনকর্তার, মানুষের অধিপতির, মানুষের উপাস্যর।
উপরে বর্ণিত তিনটি আয়াতে আল্লাহ তিনটি সিফাত বর্ণনা করা হয়েছে। রুবুবিয়াত, মালেকিয়াত ও উলুহিয়াত তথা লালন-পালন, আধিপত্য ও উপাসনা একচ্ছত্র মালিকানা আল্লাহর। মানুষকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এই মর্মে যে তার সঙ্গে সদা সর্বদা নিযুক্ত শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে যেন উপরোক্ত তিনটি গুনে গুণান্বিত মহান সত্তা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গুণের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যা কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
প্রথম গুণ হিসেবে বলা হয়েছে بِرَبِّ النَّاسِ “মানুষের পালনকর্তা”। সকল মানুষ আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মানে। কিন্তু পালনকর্তা হিসেবে মানতে অনেকে আপত্তি করে। যেমন ফেরাউন সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নিজেকেই রব বলে দাবি করেছিলেন। (নাযে’য়াত ৭৯/২৪)। পৃথিবীতে ফেরাউনি স্বভাবের অসংখ্য ধনী, সমাজ নেতা ও রাষ্ট্রনেতা রয়েছেন যারা পরোক্ষভাবে অনুরূপ দাবি করতে চান। তাই আল্লাহ এখানে তার পালনকর্তা গুনটিকে শুরুতে এনেছেন। একইভাবে সুরা ফাতিহার শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে বিশ্ব চরাচরের পালনকর্তা হিসেবে।
দ্বিতীয় গুন : مَلِكِ النَّاسِ ‘মানুষের অধিপতি’। কিয়ামতের দিন আল্লাহ পৃথিবীকে কব্জায় নিবেন আর বলবেন, “আমি বাদশা, পৃথিবী রাজা-বাদশা রা কোথায় ?”
পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজ ও রাষ্ট্রনেতা সাধারণত এই অহংকারে বুদ হয়ে থাকেন যে, সবার উপরে তারাই সত্য, তাদের উপরে নেই। তারা যা বলেন বা করেন, সেটাই চূড়ান্ত। আইন ও বিধানদাতা তারাই। তাদের বানোয়াট আইনে আদালত গুলিতে বিচার হচ্ছে। আর সেই আইনে নিরীহ মানুষের জেল- ফাঁস হচ্ছে। বাদী বিবাদী বা তাদের প্রতিনিধিকে আদালতে নির্বাক দাঁড় করিয়ে রেখে উভয়পক্ষে উকিলের আইনি বিতর্কের ফাঁক-ফকর দিয়ে নিরাপরাধ মানুষকে অপরাধী বানানো অথবা অপরাধীকে নিরাপদ বানানো প্রহসনকে প্রত্যক্ষ বিচার ব্যবস্থা বলা হচ্ছে। এরপরেও রয়েছে ন্যায় বিচারের নামে দীর্ঘসুত্রিতা। বাদী ও বিবাদী হায়াত শেষ হয়ে যায় কিন্তু বিচার শেষ হয় না। এটাই হলো আধুনিক যুগের উন্নত বিচার ব্যবস্থার নমুনা।
অন্যদিকে হাজতের নামে মেয়াদবিহীন ভাবে বছরের পর বছর ধরে কারাগারে মানুষকে ধুকে ধুকে মারা হচ্ছে। কথিত আইন ও বিচারের দোহাই দিয়ে এভাবে স্বাধীন মানুষকে ঘানির গরুর মত দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করে তিলে তিলে নিঃশেষ করা হচ্ছে। যদি চূড়ান্ত বিচারে সে বেকসুর খালাস হয়ে যায়, তখন তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি সে আর কখনোই ফিরে পায় না। মানুষের উপরে মানুষের এই মেকি প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আল্লাহ তার একাধিকত্ব ও একক সার্বভৌমত্বের গুণ প্রকাশ করে বলেছেন مَلِكِ النَّاسِ ‘মানুষের অধিপতি’। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে মানুষের অধিপতি মানুষ নয়, বরং আল্লাহ। আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান।
তৃতীয় গুণ : إِلَهِ النَّاسِ ‘মানুষের উপাস্য ’। স্রেফ ধারণা ও কল্পনার বসবতী হয়ে কিছু মানুষ ও বস্তুর উপরে অলৌকিক ক্ষমতা আরোপ করে মানুষ তাদের উপাসনা করে থাকে। তাদের কবর, মূর্তি, ছবি ও প্রতিকৃতিকে কে পূজা করে। একইভাবে নবী-অলি, ফেরেশতা, সূর্য-চন্দ্র, আগুন-পাহাড়-নদী, গাছ, পাথর এমনকি মাছ-কবুতর ও তুলসী গাছ পর্যন্ত মানুষের পূজা পাচ্ছে। সৃষ্টির সেরা মানুষ নিজেদের হাতে গড়া বেদী, মিনার, কবর, ভাস্কর্য ও সৌধের সামনে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে নিরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।
জীবন্ত মানুষ যখন ক্ষুধায় তৃষ্ণায় প্রাণ হারাচ্ছে, তখন এইসব নিষ্প্রাণ মূর্তি ও মিনারের সামনে পেছনে মানুষ অকাতরে জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয় করছে। অথচ যাকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে, যাকে পূজা দেওয়া হচ্ছে, সে না দেখতে পায়, না শুনতে পায়। সেনা কোন ক্ষতি করতে পারে, না কোন উপকার করতে পারে। এরপরেও মানুষ যাচ্ছে সেখানে দলে দলে মিথ্যা ধারণা ও কল্পনার বসবর্তি হয়ে।
সে যুগে নমরুদ নিজেকে মানুষের হায়াত- মউতের মালিক দাবি করে বলেছিল “আমি বাঁচাই ও আমি মারি” (বাক্কারাহ – ২/২৫৮)। ফেরাউন নিজেকে জনগণের “ইলাহ্” দাবি করে কওমের নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, “আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন উপাস্য আছে বলে আমি জানিনা” (সূরা ক্বছাছ : ২৮/৩৮)।
সে আরো বলেছিল, “আমি তোমাদের জন্য যেটা কল্যাণ বুঝি সেটাই বলি, আর আমি তোমাদের কেবল সৎ পথেই দেখিয়ে থাকি” (মুমিন/গাফির :৪০/২৯)। এ যুগের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের অনেকে অঘোষিতভাবে অনুরূপ দাবি করেন। কোরআন হাদিসের কল্যাণ পথ তারা দেখতে পান না। ফলে তাদের জীবদ্দশায় সরাসরি এবং মৃত্যুর পরে তাদের ছবিতে ও কবরে পূজা হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন : সূরা-ফাতিহার তাফীসর
মূলত : এইসব শয়তানের ধোকা ব্যতীত কিছুই নয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে যে, পূজা-উপাসনা ও ইবাদতের একক হকদার ও হক মা’বুদ হচ্ছেন একজন তিনি আল্লাহ তিনি একমাত্র মানুষের উপাস্য। তিনি ব্যতীত আর কোন প্রকৃত উপাস্য নেই। তিনি একমাত্র “রব” হিসাবে মানুষ ও সৃষ্টি জগতের লালন-পালন করেন, “মালিক” বা অধিপতি হিসাবে সৃষ্টি জগতের সকল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করেন এবং ইল্লাহ হিসাবে অসহায় বান্দার সকল প্রার্থনা শ্রবণ করেন ও তা মঞ্জুর করেন। এভাবে রুবুবিয়াত মালেকিয়াত ও উলুহিয়াতের একচ্ছত্র অধিকারী হিসাবে আল্লাহ অত্র সূরার শুরুতে নিজের প্রধান তিনটি গুণের পরিচয় পেশ করেছেন।
আয়াত (৪-৬) مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ,الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ,مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ ‘গোপন শয়তানের কুমন্ত্রণার অনিষ্টকারিতা হতে। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জ্বীনদের মধ্যে হতে ও মানুষের মধ্যে হতে।
বর্ণিত তিনটি আয়াতে শয়তানের কুমন্ত্রণা অনিষ্টকারিতা হতে বাঁচার জন্য মানুষকে আল্লাহর আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। কেননা শয়তান মানুষের নিত্য সঙ্গী এবং সে কাউকে ভয় পায় না আল্লাহ ব্যতীত। বান্দা যখনই আল্লাহর নাম নেয়, তখনই সে পিছিয়ে যায়। এমনকি আজান শুনলে সে বায়ু নিঃসরণ করতে করতে দৌড়ে পালায়। শয়তান মানুষের রগ রেশায় চলাফেরা করে। একে আটকানোর মতো ক্ষমতা মানুষের নেই। অথচ এর প্ররোচনাতেই মানুষ সমস্ত পাপ করে। তাই একে দমন করার একমাত্র কৌশল হিসাবে মানুষকে আল্লাহর আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।
এখানে (الْخَنَّاسِ) খান্নাস অর্থ ‘গোপন শয়তান ‘। কেননা আল্লাহর নাম শুনলে শয়তান পিছিয়ে যায় ও লুকিয়ে যায়। আবার যেমনি বান্দা বেখেয়াল হয়ে যায়, অমনি সামনে চলে আসে আর কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। এই লুকোচুরি স্বভাবের জন্য শয়তানকে অত্র আয়াতে খান্নাস বলা হয়েছে। আর এটা হলো শয়তানের প্রথম বৈশিষ্ট্য।
(৫) الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ “যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে”- এটা হল শয়তানের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য।
রাসূল সাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সঙ্গী হিসাবে শয়তানকে নিযুক্ত করা হয়নি। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও ? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও। তবে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন। সেজন্য সে অনুগত হয়ে গেছে। ফলে সে আমাকে নির্দেশ করে না, ভালো ব্যতীত”।[মুসলিম : ২৮১৪]
(৬) ,مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ “জ্বীন ও ইনসান এর মধ্যে হতে”। এখানে শয়তানকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। জ্বীন যা মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয় এবং মানুষ শয়তান যা প্রকাশ্য মানুষকে কুপরামর্শ দেয় ও পথভ্রষ্ট করে।
আল্লাহ বলেন, “আর এমনই ভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য বহু শয়তানকে শত্রুরূপে নিযুক্ত করেছি মানুষের মধ্য থেকে ও জিনদের মধ্য থেকে। তারা একে অপরকে মনমুগ্ধকর কথা দিয়ে প্ররোচিত করে থাকে। যাতে তারা ধোঁকায় পতিত হয়। যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তাহলে তারা এগুলি করতে পারত না। অতএব তুমি এদেরকে ও এদের মিথ্যা ঘটনা গুলিকে দূরে নিক্ষেপ করো”(অন’আম : ৬/১১২)
নবীদের যখন এই অবস্থা তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন হবে, তা সহজেই বোধগম্য। তবে মনের মধ্যে শয়তানি চিন্তা উদয় হলেই বান্দা গুনাগার হিসাবে বিবেচিত হবে না, যতক্ষণ না সে মুখে বলবে বা লিখবে অথবা কাজে পরিণত করবে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ আমার উম্মতের ওই সব বিষয় ক্ষমা করেছেন, যেসব বিষয় তাদের অন্তরে উদয় হয়। যতক্ষণ না তারা সে অনুযায়ী কাজ করে অথবা কথা বলে। [বুখারী : ২৫২৮]
সূরা নাস এর চিকিৎসা : সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস মানুষের অন্যতম সেরা মুজেজা স্বরূপ। এর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানের অমূল্য উৎস। যা আধুনিক পাশ্চাত্য ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ সূরা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে মানুষের উপর তার মানসিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যা ভালো ও মন্দ উভয় প্রকার পরিদৃষ্ট হয়। যেমন লাবিব বিন আসাম-এর করা কালো জাদু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ক্রিয়া করেছিল মন্দ ভাবে।
পক্ষান্তরে সূরা ফালাক ও সূরা নাস তার উপর শুভ প্রতিক্রিয়া বিস্তার করে। যাতে তিনি সুস্থ হয়ে যান। এতে প্রমাণিত হয় যে, বস্তুগত ঔষধ ছাড়াও মানসিক ঔষধ মানবদেহে অধিকরত দ্রুত কাজ করে। এমনকি অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মানসিকভাবে শক্তিশালীগন দ্রুত আরোগ্য লাভ করে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন।
কোরআন বহু পূর্বেই মনো চিকিৎসার পথ দেখিয়েছে। বরং পুরো কোরআনকে আল্লাহ বিশ্বাসীদের জন্য “শিফা” ও “রহমত” তথা “আরোগ্য” ও “অনুগ্রহ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। (বনু ইসরাইল : ১৭/৮২)।
সূরা নাস এর সারকথা : শয়তানি ধোঁকা হতে বাঁচার একমাত্র পথ হলো আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করা।