সূরার পরিচয় :
সূরার নাম : সূরা কুরাইশ (সূরা ইলাফ) | সূরার অর্থ : বণিক বা ব্যবসায়ী। |
সূরা নং : ১০৬ | রুকু সংখ্যা : ১ |
আয়াত সংখ্যা : ৪ | সিজদা সংখ্যা : ০ |
শব্দ সংখ্যা : ১৭ | শ্রেণী : মাক্কী |
বর্ণ সংখ্যা : ৭৫ | পারার সংখ্যা : ৩০ |
সূরা কুরাইশ سورة قريش Surah quraysh এর তাফসির ও শানে নুযুল
بسم الله الرحمن الرحيم ”শুরু করছি আল্লাহ তা’আলার নামে; যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।” |
(١)-لِإِيلَٰفِ قُرَيْشٍ (১) কুরাইশের আসক্তির কারণে; |
(٢)-إِلَٰفِهِمْ رِحْلَةَ ٱلشِّتَآءِ وَٱلصَّيْفِ (২) আসক্তির কারণে তাদের শীত ও গ্রীষ্মকালীন সফরের। |
(٣)-فَلْيَعْبُدُوا۟ رَبَّ هَٰذَا ٱلْبَيْتِ (৩) অতএব, তারা যেন ইবাদত করে এই ঘরের পালনকর্তার। |
(٤)-ٱلَّذِىٓ أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍ وَءَامَنَهُم مِّنْ خَوْفٍۭ (৪) যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং যুদ্ধভীতি থেকে নিরাপদ করেছেন। |
শাব্দিক বিশ্লেষণ
لِإِيلَٰفِ: শব্দটির মূল হলো إِيلَٰفِ অভ্যস্ত হওয়া, অন্তরঙ্গ হওয়া, আসক্ত হওয়া) إِيلَٰفِ (অভ্যস্ততা) আর لِإِيلَٰفِ অর্থ: অভ্যস্ততার জন্য বা কারণে।
قُرَيْشٍ : শব্দটি বিশেষ্য, কুরাইশ আরবের একটি গোত্রের নাম। لِإِيلَٰفِ قُرَيْشٍ কুরাইশদের অভ্যস্ততার জন্য।
فَلْيَعْبُدُوا۟ : শব্দটির মূল হলো عبادة (ইবাদত করা, উপাসনা করা, আনুগত্য করা) । يَعْبُدُوا۟ (তারা ইবাদত করে) ক্রিয়া, বর্তমানকাল, প্রথম পুরুষ, পুংলিঙ্গ, বহুবচন। فَلْيَعْبُدُوا۟ অর্থ: অতএব তাদের উচিত ইবাদত করা।
أَطْعَمَهُم : শব্দটির মূল হলো اطعام (খাওয়ানো, খাদ্য, জোগানো, আহার দেওয়া ) اطعام (তিনি আহার দিয়েছেন) ক্রিয়া, অতীতকাল, প্রথম পুরুষ, একবচন, পুংলিঙ্গ। কর্ম হিসেবে সর্বনাম هم (তাদের) এসেছে। ٱلَّذِىٓ أَطْعَمَهُم অর্থ: যিনি তাদেরকে আহার দান করেছেন ।
امن : শব্দটির মূল হলো ايمن (বিশ্বাস করা, ঈমান আনা, নিরাপদ করা) امن (তিনি নিরাপদ করেছেন) । ক্রিয়া, অতীতকাল, প্রথম পুরুষ, একবচন, পুংলিঙ্গ। امَنَهُم অর্থঃ তিনি তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।
সূরার আলোচ্য বিষয়
কয়েকটি নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হিসেবে কুরাইশ গোত্রের লোকদেরকে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের প্রতি দাওয়াত দেওয়াই সূরা কুরাইশের আলোচ্য বিষয় ৷ পূর্বের সূরার সাথে যোগসূত্র এ সূরার মূল বক্তব্যের সাথে সূরা ফীলের বিষয়বস্তুর গভীর মিল পরিলক্ষিত হয়। ফলে কেউ কেউ উভয় সূরাকে এক সূরা হিসেবে গণনা করেন। কেননা পূর্ববর্তী সূরার মতো এ সূরায়ও কাবার আশপাশে অবস্থিত কুরাইশদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটা স্বতন্ত্র সূরা, না সূরা ফীলের অংশ এ বিষয়ে মুফাসসিরীনে কেরামের দুই রকমের মতামতই পাওয়া যায়।
ক. কারো কারো মতে, এটা সূরা ফীলের অংশ বিশেষ। হযরত উবাই ইবনে কাব রা.-এর নিকট রক্ষিত মাসহাফে এই দুটি সূরার মাঝে বিসমিল্লাহ লিখে পাথক্য করা হয়নি। আবার হযরত ওমর রা.ও একবার কোনো পার্থক্য না করে এই দুই সূরাকে মিলিয়ে পড়েছিলেন।
খ. হযরত ওসমান রা. যখন তাঁর খেলাফতকালে কুরআনের সমস্ত মাসহাফ একত্র করে এক কপিতে সংকলন করেন এবং সকল সাহাবীর ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয় । তখন তাতে এই দুই সূরাকে সতন্ত্র দুই সূরা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং উভয়ের মাঝে বিসমিল্লাহ লেখা হয়। তাই কুরআনে সূরা দুটি স্বতন্ত্র দুই সূরা হিসেবে সাব্যস্ত হয়।
সূরা কুরাইশ এর শানে নুযুল ও নামকরণ:
সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখিত কুরাইশ শব্দ থেকেই এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এই সূরার অন্য নাম হচ্ছে- সূরা ইলাফ।
উম্মে হানি বিনতে আবু তালেব হতে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুরাইশদের ৭ টি বিষয়ে মর্যাদা দান করা হয়েছে।
১. আমি তাদের মধ্য হতে।
২. নবুওয়াত তাদের মধ্যে থেকে হতে এসেছে।
৩. আল্লাহ তাদের হস্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন।
৪. হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব।
৫. কাবা ঘরের তত্বাবধান।
৬. উক্ত ঘটনার পর কুরাইশরা ১০ বছর যাবৎ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কারো ইবাদত করেনি। (হস্তি বাহিনীর ঘটনা)
৭. আল্লাহ তা’আলা তাদের বিষয়ে কুরআনুল কারীমে পৃথক একটি সূরা নাযিল করেছেন; যেখানে তাদের ব্যতীত আর কারোর আলোচনা করা হয়নি।
সূরা কুরাইশ এর তাফসীর
আয়াত-১.
لِإِيلَٰفِ قُرَيْشٍ কুরাইশের (লোকদের আমি যা কিছু দান করেছি তা হলো তাদের) আসক্তি ও অভ্যস্ততার কারণে। আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী ل অব্যয়ের সম্পর্ক কোনো পূর্ববর্তী বিষয়বস্তুর সাথে হয়ে থাকে। এ আয়াতের শুরুতে উল্লিখিত ل এর সম্পর্ক কিসের সাথে, এ সম্পর্কে একাধিক উক্তি বর্ণিত হয়েছে। সূরা ফীলের সাথে অর্থগত সম্পর্কের কারণে কেউ কেউ বলেন যে, এখানে একটি উহ্য বাক্যের মাধ্যমে ل – এর সম্পর্ক সূরা ফীলের সাথে। আর সে উহ্য বাক্যটি হলো, إنا أهلكنا اصحاب الفيل, আমি হস্তী বাহিনীকে ধ্বংস করেছি لِإِيلَٰفِ قُرَيْشٍ কুরাইশদের আসক্তির কারণে। যাতে তাদের শীত ও গ্রীষ্মকালীন দুই ভ্রমণের পথে কোনো বাধা-বিপত্তি না থাকে এবং সবার অন্তরে তাদের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
আয়াত-২
শীত ও গ্রীস্মের সফরে الفهم رحلة الشتاء والصيف তাদের অভ্যস্ত হওয়ার কারণে। মক্কা শহরে কোনো চাষাবাদের পরিস্থিতি নেই। তাই বাণিজ্যিকভাবে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় শীত ও গ্রীষ্মের সফরে জীবনোপকরণ সংগ্রহ করার ওপর মক্কাবাসীদের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। ইববে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত মক্কাবাসীরা খুব দারিদ্র্য ও কষ্টে দিনাতিপাত করত। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা উদ্বুদ্ধ হয়। সিরিয়া ছিল ঠাণ্ডা দেশ। তাই গ্রীষ্মকালে তারা সিরিয়া ভ্রমণ করত।
পক্ষান্তরে ইয়ামেন গরম দেশ ছিল বিধায় তারা শীতকালে সেখানে বাণিজ্যিক ভ্রমণ করত। আল্লাহর ঘরের খাদেম হওয়ার কারণে বিশেষ করে হস্তী বাহিনীর শিক্ষণীয় ঘটনার ফলে সমগ্র আরবে তারা ছিল সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। ফলে পথের বিপদাপদ থেকে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মক্কাবাসীদের প্রতি এসব অনুগ্রহ ও নিয়ামতের কথা উল্লেখ করে পরবর্তী আয়াতে এই ঘরের প্রতিপালকের ইবাদত করার নির্দেশ করেছেন।
আয়াত-৩
কুরাইশদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ উল্লেখ করার পর এ আয়াতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, فليعبدوا رب هذا البيت অতএব তোমরা এই ঘরের মালিকের ইবাদত করো। এই ঘরই যেহেতু তাদের সব শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণের উৎস ছিল, তাই বিশেষভাবে এই ঘরের মৌলিক গুণটি উল্লেখ করা হয়েছে।
আয়াত-৪
যিনি তাদেরকে উল্লিখিত দুই সফরের মাধ্যমে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং কাবা ঘরের বরকতে ভয়-ভীতি থেকে নিরাপত্তা দান করেছেন। হস্তী বাহিনীর কষ্টদায়ক আঘাত থেকেতাদেরকে নিরাপদ রেখেছেন। সুখী জীবনের জন্য যা যা দরকার, তা সবই এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍ ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন, এতে পানাহারের সরঞ্জাম বোঝানো হয়েছে। আর امَنَهُم مِّنْ خَوْفٍۭ ‘ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে নিরাপত্তা দিয়েছেন’।বলে শত্রুদের থেকে নিরাপত্তা এবং পরকালীন আজাব থেকে নিষ্কৃতি এ উভয় মর্মইবোঝানো হয়েছে। তার পরও তারা সেই ঘরের মালিকের ইবাদত না করা অবশ্যই অকৃতজ্ঞতার প্রমাণ বহন করে।
নির্দেশনা
১. যে আল্লাহ ক্ষুধার্তকে আহার দেন এবং ভয়-ভীতি থেকে নিরাপত্তা দেন ইবাদত কেবল সেই আল্লাহর জন্যই হতে হবে।
২. ক্ষুধার সময় খাদ্য পাওয়া এবং ভয়ের সময় নিরাপত্তা পাওয়া অনেক বড় নিয়ামত।
৩. আবুল হাসান কার্যবিনী রহ. বলেন, ‘যে ব্যক্তি শত্রু অথবা বিপদের আশঙ্কা করে তার জন্য সূরা কুরাইশের তিলাওয়াত করা রক্ষাকবচ। ইমাম জারী, মির্জা মাযহার জানেজান ও কাজী ছানাউল্লাহ রহ. বলেছেন, এটা পরীক্ষিত আমল।
ট্যাগ সমূহ : সূরা কুরাইশ,surah quraysh,سورة قريش,سوره قريش,সূরা কুরাইশ বাংলা উচ্চারণ, সূরা কুরাইশ এর শানে নুযুল, সূরা কুরাইশ এর তাফসীর,সূরা কুরাইশ এর ব্যাখ্যা,সূরা কুরাইশ তেলাওয়াত, সূরা কুরাইশ অর্থসহ, সূরা কুরাইশ আরবি, সূরা কুরাইশ এর আয়াত সংখ্যা কত,সূরা কুরাইশ কোথায় অবতীর্ণ হয়,সূরা কুরাইশ এর দারস, সূরা কুরাইশের শব্দের সংখ্যা কত, সূরা কুরাইশের বর্ণের সংখ্যা কত,সূরা কুরাইশ,surah quraysh,سورة قريش,سوره قريش,সূরা কুরাইশ বাংলা উচ্চারণ, সূরা কুরাইশ এর শানে নুযুল, সূরা কুরাইশ এর তাফসীর,সূরা কুরাইশ এর ব্যাখ্যা,সূরা কুরাইশ তেলাওয়াত |
আরো পড়ুন :
১০৭.সূরা মাউন سورة الماعؤن Sura maun এর তাফসীর ও শানে নুযুল
১০৮.সূরা কাউসার سورة الكوثر Sura kawsar এর তাফসির ও শানে নুযুল
১০৯.সূরা কাফিরুন سورة الكافرون sura kafirun এর তাফসীর ও শানে নুযুল