সূরা কাফিরুন এর পরিচয় :
সূরার নাম : সূরা কাফিরুন | সূরার অর্থ : অবিশ্বাসীগণ |
সূরা নং : ১০৯ | রুকু সংখ্যা : ১ |
আয়াত সংখ্যা : ৬ | সিজদা সংখ্যা : ০ |
শব্দ সংখ্যা : ২৬ | শ্রেণী : মাক্কী |
বর্ণ সংখ্যা : ৯৩ | পারার সংখ্যা : ৩০ |
সূরা কাফিরুন سورة الكافرون sura kafirun এর তাফসীর ও শানে নুযুল
بسم الله الرحمن الرحيم শুরু করছি আল্লাহর নামে; যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। |
(١)- قل يَٰٓأَيُّهَا ٱلْكَٰفِرُونَ ১) বলুন, হে কাফেরকুল। |
(٢)-لَآ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ ২) আমি ইবাদত করি না, তোমরা যার ইবাদত করো। |
(٣)-وَلَآ أَنتُمْ عَٰبِدُونَ مَآ أَعْبُدُ (৩) এবং তোমরাও ইবাদতকারী নও; যার ইবাদত আমি করি। |
(٤)-وَلَآ أَنَا۠ عَابِدٌ مَّا عَبَدتُّمْ (৪) এবং আমি ইবাদতকারী নই; যার ইবাদত তোমরা করো। |
(٥)-وَلَآ أَنتُمْ عَٰبِدُونَ مَآ أَعْبُدُ (৫) তোমরা ইবাদতকারি নও; যার ইবাদত আমি করি । |
(٦)- لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِىَ دِينِ (৬) তোমাদের ’কর্মফল’ তোমাদের জন্য এবং আমার ’কর্মফল’ আমার জন্য। |
শাব্দিক বিশ্লেষণ :
ٱلْكَٰفِرُونَ : (কাফেরগণ, অবিশ্বাসীগণ, অস্বীকারকারীগণ), কর্তাবাচক বিশেষ্য, বহুবচন, পুংলিঙ্গ । আর كافر একবচন। كفرا ক্রিয়ামূল, অর্থ হলো কুফরী করা, অবিশ্বাস করা, গোপন করা ইত্যাদি ।
لَآ أَعْبُدُ : (আমি উপাসনা করি না), না-বোধক বর্তমানকাল, একবচন, উত্তম পুরুষ, পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ সমান।
تَعْبُدُونَ : (তোমরা ইবাদত করছো), হ্যাঁ-বোধক বর্তমানকাল, বহুবচন, মধ্যম পুরুষ, পুংলিঙ্গ ।
عَٰبِدُونَ : (তোমরা ইবাদতকারীগণ), কর্তাবাচক ক্রিয়া বিশেষ্য, বহুবচন, পুংলিঙ্গ। একবচন عَابِدٌ
عَابِدٌ : (ইবাদতকারী), কর্তাবাচক ক্রিয়া বিশেষ্য, একবচন, পুংলিঙ্গ । বহুবচন عَٰبِدُونَ
عَبَدتُّمْ : (তোমরা ইবাদত করেছো), সাধারণ অতীতকাল, বহুবচন, মধ্যম পুরুষ, পুংলিঙ্গ ।
دِينِ : (দ্বীন, ধর্ম, জীবনব্যবস্থা, শেষ বিচার, কর্মফল), শব্দটি একবচন, বহুবচন হলো- اديان
আলোচ্য বিষয়
আলোচ্য সূরা কাফিরূনে একত্ববাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং কেবলমাত্র আল্লাহই ইবাদতের উপযুক্ত সে বিষয়টি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে অংশীদার করা যাবে না তার শিক্ষা রয়েছে এই সূরায়।
সূরা কাফিরুন এর শানে নুযুল :
আলোচ্য সূরাটি নাযিলের প্রেক্ষাপট হলো ইবনে আবী হাতেম বর্ণনা করেন, একদা ওয়ালীদ ইবনে মুগিরা, আ’স ইবনে ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ও উমাইয়া ইবন খলফ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় কুরাইশ রাসূল স.-এর কাছে আগমন করে বলল, হে মুহাম্মদ! ধর্ম-কর্ম বিষয়ে আপনার ও আমাদের বিবাদে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। আসুন, আমরা পরস্পরে একটি শান্তিচুক্তি করি। আর তা হলো, আপনি আপনার খোদার ইবাদতের সাথে সাথে আমাদের উপাস্যদেরও উপাসনা করবেন এবং আমরাও আমাদের উপাসনার সাথে সাথে আপনার খোদার ইবাদত করব। তাহলে আমাদের চলমান বিবাদ শেষ হবে এবং আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ধর্মীয় বিষয়ে অংশীদার হবো।
অপর বর্ণনা মতে তারা বলেছিল, এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদত করবেন এবং এক বছর আমরা আপনার উপাস্যের ইবাদত করব। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তারা বলেছিল, আপনি আমাদের কোনো প্রতিমার গায়ে কেবল হাত লাগিয়ে দিন, আমরা আপনাকে সত্য বলব। এর প্রেক্ষিতে জিবরাঈল (আ:) ’সূরা কাফিরূন’ নিয়ে আগমন করলেন। (মাআরিফুল কোরআন)
সূরা কাফিরুন এর তাফসীর :
আয়াত-১-৫.
হে মুহাম্মদ! বলুন, হে কাফেররা! আমি ইবাদত করি না তোমরা যার ইবাদত করো । আমি এক আল্লাহর ইবাদত করি। তিনি ব্যতীত তোমরা যে সকল উপাস্য গ্রহণ করেছো তাদের ইবাদত করি না। বর্তমানেও না, ভবিষ্যতেও না। আর তোমরাও ইবাদতকারী যার ইবাদত আমি করি।
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহর ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করার কথাটি গুরুত্ব দিয়ে বিবৃত হয়েছে। অন্যকে শরীক করা যে তাওহীদবহির্ভূত এবং একত্ববাদের পরিপন্থি, তা সুস্পষ্ট হয়েছে। এ সূরায় একই বাক্য বারবার উল্লেখ করার রহস্য হিসেবে ইমাম বুখারী রহ কয়েকজন তাফসীর বিশারদ ইমামের মতামতের আলোকে লিখেছেন,
একই বাক্য একবার বর্তমানকালের জন্য এবং একবার ভবিষ্যৎকালের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের মর্ম হবে, আমি বর্তমানে তোমাদের উপাস্যদের ইবাদত করি না এবং তোমরা আমার উপাস্যের ইবাদত বর্তমানে করো না। আর আমি ভবিষ্যতেও তোমাদের উপাস্যদের ইবাদত করব না এবং তোমরাও ভবিষ্যতে (কাফের থাকা অবস্থায়) আমার উপাস্যের ইবাদত করবে না।
ইমাম ইবনে কাসীর রহ. বলেন , مَا تَعْبُدُونَ এবং مَآ أَعْبُدُ এর মধ্যে مَآ শব্দটি দুই আয়াতে দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক আয়াতে শব্দটি موصوله অর্থ: যার। মর্ম হলো আমি তার ইবাদত করি না, যার ইবাদত তোমরা করো। অপর আয়াতে শব্দটি مصدريه অর্থ: যেভাবে বা যে পদ্ধতিতে। মর্ম হলো, আমি ইবাদত করি না যেভাবে ইবাদত তোমরা করো। তোমাদের ইবাদতের পদ্ধতি হলো স্বকল্পিত ও মনগড়া। আর আমার ইবাদতের পদ্ধতি হলে৷ ওহীর মাধ্যমে আল্লাহপ্রদত্ত।
আয়াত-৬.
তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আর আমার জন্য আমার ধর্ম। আমি আমার ধর্ম অনুযায়ী চলব, তোমাদের ধর্ম মেনে নেব না, আমি আল্লাহর সাথে শিরক করব না। আমার আনীত এ ধর্ম সত্য, যা তোমরা বিশ্বাস করছো না। আমি আমার ধর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট । দুর্ভাগ্যবশত তোমরা নিজেদের জন্য যে পথ অবলম্বন করেছো, সে বিষয়ে তোমরাই ভালো জানো, তোমরা তোমাদের ধর্ম মতে চললে চলতে থাকো।
ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অস্তিত্ব নেই
এই সূরার শানে নুযূলের আলোকে বোঝা যায় মূর্তি পূজারীরা রাসূলুল্লাহ স.-এর সাথে ধর্মীয় বিষয়ে সন্ধি করতে চেয়েছিল। তাদের দাবি ছিল, রাসূলুল্লাহ স. তাদের ধর্মীয় কাজ সমর্থন করবেন বা তাদের সাথে অংশ নেবেন। তাহলে তারাও রাসূলুল্লাহ স.-এর সাথে আল্লাহর ইবাদতে অংশ নেবে। আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের শেষ বাক্যে বলেছেন, তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য আর আমার জন্য আমার ধর্ম। এর মর্ম হলো, তোমরা যদি আমার সত্য ধর্মে কখনো না আসো তবুও আমি তোমাদের ধর্মীয় কাজ পালন করব না। আমি আমার ধর্মই পালন করব। এ কারণে যদি তোমরা সত্য ধর্ম গ্রহণ করতে না চাও, এতে আমি তোমাদের প্রস্তাব মানতে পারি না। যদিও তোমরা তোমাদের ধর্মে অটল থাকো।
এ ছাড়া উল্লিখিত সূরার কয়েকটি আয়াতে কাফেরদেরকে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আমি ইবাদত করি না, যার ইবাদত তোমরা করো। অতএব ওপরের আয়াতগুলো উপেক্ষা করে সূরার সর্বশেষ আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা করে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম প্রমাণের প্রয়াস ভ্রান্ততারই পরিচায়ক মাত্র। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে, কখনো তা গ্রহণ করা হবে না এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা আলে ইমরান-৮৫)
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِىَ دِينِ এর তাফসীর প্রসঙ্গে ইবনে কাসীর রহ. বলেন, دِينِ (দ্বীন) শব্দটি কুরআনে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ আয়াতে দ্বীন অর্থ: প্রতিদান ও পরিণাম বা কর্মফল। আয়াতের মর্ম হলো, তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্য এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্য । মোটকথা, নিজ নিজ কর্মের প্রতিদান ও শাস্তি প্রত্যেককে নিজেই ভোগ করতে হবে।
অতএব আয়াতে যার যে ধর্ম ইচ্ছা, সে অনুযায়ী পালন করা তথা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ বা সেক্যুলারিজমের কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং আয়াতের দাবি হলো, কেউ ভ্রান্ত মতবাদ পালন করলে এর শাস্তি তাকে ভোগ করতে হবে।
অপর আয়াতে মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘আর যদি আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তবে বলুন, আমার জন্য আমার কর্ম, আর তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। তোমাদের দায়দায়িত্ব নেই আমার কর্মের ওপর এবং আমারও দায়দায়িত্ব নেই তোমরা যা করো সে জন্য । (সূরা ইউনূস-৪১)
শান্তিচুক্তির নীতিমালা ও মদীনা সনদের বাস্তব তথ্য :
আলোচ্য সূরায় কাফেরদের প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তির প্রস্তাব সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ স্বয়ং কুরআন ঘোষণা করেছে, وإن جنحوا للسلم فاجنح لها কাফেররা সন্ধি করতে চাইলে তোমরাও সন্ধি করো । (সূরা আনফাল-৬১)
সূলুল্লাহ স. মদীনায় হিজরত করার পর ইহুদীদের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। যা মদীনার সনদ হিসেবে পরিচিত। হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ স. মক্কাবাসীদের সাথেও সন্ধি করেছিলেন। আসলে শান্তিচুক্তি দুই ধরনের হতে পারে। বৈধ শান্তিচুক্তি ও অবৈধ শান্তিচুক্তি। উল্লিখিত আয়াতে এবং মদীনার সনদে যে ধরনের শান্তিচুক্তির অনুমতি বা বৈধতা জানা যায়, তা সে সময় যেমন বৈধ ছিল, আজও তেমনি বৈধ আছে। বৈধতা ও অবৈধতার আসল ভিত্তি হচ্ছে সন্ধির পদ্ধতি, নীতিমালা ও শর্তাবলি।
সন্ধি-চুক্তির ক্ষেত্রে মুসলমানদের বিশেষ দুটি বিষয় লক্ষ করতে হবে এক. যে শান্তিচুক্তি করা হবে। এতে মুসলমানদের কল্যাণ নিহিত থাকতে হবে। যে সন্ধি-চুক্তিতে মুসলমানদের ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল হয় তা মুসলমানদের জন্য বৈধ হবে না। (হেদায়া)
দুই. ইসলামী শরীয়তসম্মত ও বৈধ বিষয়ে শান্তিচুক্তি হতে হবে। তাই এ ধরনের সন্ধি অবৈধ, যা কোনো হারামকে হালাল, কিংবা হালালকে হারাম করে। রাসূলুল্লাহ স. বলেন, إلا صلحا أحل حراما أوخرم خلالًا ‘সন্ধি-চুক্তির অনুমতি আছে, তবে যে সন্ধি হারামকে হালাল অথবা হালালকে হারাম করে, এমন সন্ধি বৈধ নয়।’ (তিরমিযী-১৩৫২, সহীহ)
উল্লেখ্য যে, সূরা কাফিরনে কাফেরদের প্রস্তাবিত চুক্তি মেনে নিলে শিরক করা জরুরি হয়ে পড়ে। এ ধরনের সন্ধি নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে ইহুদীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি মদীনার সনদ এবং হুদায়বিয়া সন্ধির চুক্তিনামায় ইসলামের মূলনীতিবিরুদ্ধ কোনো বিষয় ছিল না। মদীনা সনদের ৬১টি ধারা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কল্যাণমূলক ছিল। শান্তি, সোহাগ, উদারতা, সহযোগিতা ও মানব কল্যাণে ইসলামের সাথে কোনো ধর্মের তুলনা হয় না। শান্তিচুক্তি মানবিক অধিকারের ব্যাপারে হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ স. প্রতিটি শান্তিচুক্তিতে শান্তি ও মানবতার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে শান্তিচুক্তির নামে আল্লাহ তা’আলার আইন ও ধর্মের মূলনীতিতে কোনো প্রকার দর-কষাকষির অবকাশ নেই। ইসলামের কোনো বিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা কারো কাছে নেই।
বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয় জঘন্যতম শিরকি মতবাদ
বাদশাহ আকবর ভারতর্ষে প্রচলিত সব ধর্মের সমন্বয়ে দ্বীনে এলাহী নামে একটি নতুন যৌথ ধর্ম আবিষ্কার করার চক্রান্তে পা দিয়েছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশে কোয়ান্টাম মেথড নামক একটি নাস্তিক সংগঠক বাদশাহ আকবরের অনুকরণে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলমান সবার সমন্বয়ে মেডিটেশন তথা ধ্যান-সা অনুশীলন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত মক্কার কাফের সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় অনুশাসন এবং ইসলাম ধর্মের সমন্বয়ে একটি শিরকি মতবাদ রচনার প্রস্তাব নিয়েই রাসূলুল্লাহ স.-এর কাছে এসেছিল। উল্লিখিত সূরার আলোকে দ্বীনে এলাহী এবং কোয়ান্টাম মেথড ইত্যাদি সব শিরকি মতবাদ চিরতরে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেছে।
ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ও ইসলামী বিধান
ধর্মনিরপেক্ষবাদ শব্দটির বিস্তৃত অর্থ ও বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। ইংরেজি ভাষায় বলে Secularism (সেক্যুলারিজম)। আর এর আবরী হলো علمانية (আলমানিয়া) । আধুনিক বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্লেষণ বিভিন্নভাবে করা হচ্ছে। বহুল প্রচলিত কয়েকটি দিক অতি সংক্ষেপে আলোচনার প্রয়াস পাব।
এক. ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে فضل الدين عن السياسة রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থেকে ধর্ম হবে বিচ্ছিন্ন । ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। এই মতবাদের প্রেক্ষিতে ধর্ম সব ধরনের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। বিচার, প্রশাসন, অর্থ, সামাজিকতা এবং রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানসংবলিত সব কিছু বাতিল বলে গণ্য হবে। এই মতবাদের বিশ্বাসীদেরকে দুই ভাবে বিভক্ত পাওয়া যায় ।
ক. নাস্তিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী। তারা ধর্মকেই মানে না। তাই যেকোনো ক্ষেত্রে তারা ধর্মকে আফিম বা মাদক নেশা মনে করে। তারা যে ধর্মহীন এবং তাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতেই ধর্মহীনতা—এ বিষয়টা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। এ অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি কুফরী মতবাদ। ইসলামে এই মতবাদের অস্তিত্ব নেই। মহান প্রভু
ঘোষণা করেন, ‘আর তাদের মাঝে আপনি ফয়সালা করুন ওই আইন দ্বারা, যা আপনার প্রতি আল্লাহ তা’আলা অবতরণ করেছেন।’ (সূরা মায়িদাহ-৪৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না তারা জালেম। যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না তারা কাফের। যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না তারা ফাসেক (ধর্মহীন)। (সূরা মায়িদাহ-৪৪, ৪৫, ৪৭)
খ. আস্তিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী । আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে বলে তারা দাবি করে। ধর্মীয় অনেক বিষয় তারা পালন করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় এবং ইহকালীন বিভিন্ন বিষয়কে তারা পৃথকভাবে চিন্তা করে। তাদের দাবি হলো ধর্মীয় কার্যক্রম মসজিদ-মাদরাসায় সীমাবদ্ধ থাকবে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। তাদের কথা মতে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার । রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ক্ষেত্রে ধর্মকে তারা প্রতিবন্ধক হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকে। এ মতবাদটি প্রথম মতবাদের তুলনায় আরো বেশি মারাত্মক। তারা যেমন ধর্মহীন, তেমনি আবার মুনাফিক । আপনি পুরো কুরআন মাজীদ, বিশেষ করে মাদানী সূরাগুলো মনোযোগ দিয়ে অর্থসহ পড়ুন এবং লক্ষ করুন তাতে নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদির বাইরে অন্যান্য বিষয়ের আরো কত আয়াত রয়েছে।
হাদীস গ্রন্থগুলোতে ইবাদত অধ্যায়গুলোর তুলনায় পরিবারনীতি, সমাজনীতি, বিচারনীতি, লেনদেন পদ্ধতি, কৃষি-সেচ ইত্যাদি অধ্যায়গুলোর হাদীস সংখ্যার তুলনামূলক হিসাব করুন, তাহলে দেখবেন দ্বিতীয় অংশের হাদীসের সংখ্যা কত বেশি। সেক্যুলারিজম মানতে হলে আপনাকে ওই সব আয়াত এখন রহিত হয়ে গেছে-ঘোষণা করতে হবে।
তাই কোনো মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ সমর্থন করতে পারে না। আর এ অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষতার অপর নাম ধর্মহীনতা। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যাবতীয় সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান রয়েছে কুরআন-হাদীসে। তাই সেক্যুলাররা কুরআন-হাদীসকে তাদের জন্য প্রতিবন্ধক মনে করে। পক্ষান্তরে বাইবেল, গীতা, বেদ ও মহাভারতে এসব বিষয় নেই। তাই এসব গ্রন্থ নিয়ে সেক্যুলারদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। সেক্যুলারিজম এসেছেই ইসলামকে প্রতিহত করার জন্য। স্রষ্টার আইনের বদলে নিজেদের ইচ্ছামতো মানুষকে
শাসন করার জন্য।
সূরা কাফিরূনে এই মনগড়া সেক্যুলারিজমকে পূর্ণাঙ্গভাবে মূলোৎপাটন করা হয়েছে। অপর আয়াতে মহান প্রভু ঘোষণা করেন, يأيها الذين امنوا ادخلوا في السلم كافة হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। (সূরা বাকারা-২০৮)
অপর এক আয়াতে বলেন, তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশ অবিশ্বাস করো? যারা এরূপ করে পার্থিক জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনোই পথ নেই । কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেওয়া হবে। (সূরা বাকারা-৮৫)
দুই. সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ সব ধর্ম থেকে সমান দূরত্ব বজায় রাখা তথা নিরপেক্ষ থাকা বোঝানো হয়, তাহলেও এর উদ্দেশ্য হবে ধর্মহীনতা। আমরা জানি, নিরপেক্ষ তাকেই বলে যে কোনো পক্ষের সাথেই সংশ্লিষ্ট নয়। অতএব, ধর্মনিরপেক্ষ মানে যে ব্যক্তি কোনো ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নেই। সে অর্থে কোনো মুসলমান সেক্যুলার হতে পারে না। মুসলমান যেভাবে ইসলাম ছাড়া অপর কোনো ধর্ম গ্রহণ করতে পারে না, ইসলাম থেকে ভিন্নও হতে পারে না। অতএব, সব মুসলমানকেই ধর্মীয় বিষয়ে নিরপেক্ষ না হয়ে ইসলামের পক্ষে থাকা যৌক্তিক বিবেচনা এবং কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ। ‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে, কখনো তা গ্রহণ হবে না।’ (সূরা আলে ইমরান-৮৫)
তিন, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সব ধর্মের মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। এই অর্থে বিষয়টা পালন করা হলে তা ইসলাম নির্দেশিত এবং ইসলামী আদর্শের বাস্তব উদাহরণ। ইসলাম সব ধর্মের স্বাধীনতা ও সাম্য-মৈত্রীর বাস্তব নজির স্থাপন করেছে। গায়ের জোরে মুসলমান বানানোর একটি উদাহরণও ইসলামী ইতিহাসে নেই। (সূরা বাকারা-২৫৬)
ইসলামের অতুলনীয় সৌন্দর্যের অন্যতম হলো, ধর্মীয় বিষয়ে কেবল উপদেশ প্রদানের কথাই আছে। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘আপনি তাদের শাসক নন।’ (সূরা গাশিয়া-২২)
ইসলাম শান্তির ধর্ম। সর্বজনীন ও কল্যাণকামী ধর্ম ইসলাম। শান্তি, মুক্তি ও মানবতার চিরকল্যাণ নিয়ে এসেছে এই ধর্ম। কিন্তু বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের তল্পীবাহকগণ এই আদের্শের ধারে-কাছেও নেই। তাদের প্রতিটি কথা ও কর্ম প্রমাণ করে ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তারা ইসলামকে বিদায় জানাতে মরিয়া হয়ে নেমেছে। তুরস্ক এর বাস্তব উদাহরণ।
হারামাইন শরীফাইনের দীর্ঘকালের শাসক সেই তুরস্কে যখন কামাল আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল; তখন সেখানে যাবতীয় ইসলামী ঐতিহ্য ম্লান হয়েছিল। তুর্কি ভাষায় আযান হতো। গর্তের ভেতরে লুকিয়ে কুরআন শিক্ষা করতে হতো। সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ও সর্বসাধারণসহ গোটা রাজ্যটাকে সে ধর্মহীনতায় রূপান্তরিত করার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল। তার অনুসারীরা আজও দেশে দেশে ইসলামী কালচারের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের নামে ধর্মহীন মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
নির্দেশনা
১. এই সূরার আলোকে বলা যায় যে, কে বিশ্বাসী হবে আর কে অবিশ্বাসীই থেকে যাবে, তা আল্লাহ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত।
২. শান্তিচুক্তির যে আবেদন মুশরিকরা দিয়েছিল এই সূরার মাধ্যমে তার ফয়সালা আল্লাহ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামের মূলনীতিবিরুদ্ধ কোনো সন্ধি ও শান্তিচুক্তি বৈধ নয়।
ট্যাগ সমূহ : সূরা কাফিরুন, sura kafirun bangla,سورة الكافرون সূরা কাফিরুন বাংলা উচ্চারণ, সূরা নাস সুরা ফালাক সূরা ইখলাস এবং সূরা কাফিরুন, সূরা কাফিরুন উচ্চারণ, সূরা কাফিরুন বাংলা উচ্চারণসহ অর্থ, sura kafirun سورة الكافرون, সূরা কাফিরুন এর তাফসীর, সূরা কাফিরুন এর শানে নুযুল, সূরা কাফিরুনের শব্দের সংখ্যা, সূরা কাফিরুন এর অর্থ কি, সূরা কাফিরুনের বর্ণের সংখ্যা,সূরা কাফিরুন, sura kafirun bangla,سورة الكافرون সূরা কাফিরুন বাংলা উচ্চারণ, সূরা নাস সুরা ফালাক সূরা ইখলাস এবং সূরা কাফিরুন, সূরা কাফিরুন উচ্চারণ, সূরা কাফিরুন বাংলা উচ্চারণসহ অর্থ, sura kafirun سورة الكافرون, সূরা কাফিরুন এর তাফসীর, সূরা কাফিরুন এর শানে নুযুল, সূরা কাফিরুনের শব্দের সংখ্যা, সূরা কাফিরুন এর অর্থ কি, সূরা কাফিরুনের বর্ণের সংখ্যা, |
আরো পড়ুন :
১১৩. সূরা ফালাক Sura Falak سورة الفلق এর তাফসির ও শানে নূযুল
১১২.সূরা ইখলাস سورة الاخلاص Sura Ikhlas এর তাফসির ও শানে নুযূল
১১১. সূরা লাহাব Sura lahab سورة المسد এর তাফসির ও শানে নুযুল