০১.সূরা আল ফাতিহা سورة الفاتحة Surah Fatiha এর তাফসির ও শানে নুযুল

সূরা আল ফাতিহার সানে নুযুল,সূরা ফাতিহার তাফসীর,সূরা ফাতিহা,সূরা ফাতিহা বাংলা অর্থ,সূরা ফাতিহা বাংলা উচ্চারণ, সূরা ফাতিহার শানে নুযুল, সূরা ফাতিহা অর্থ, সূরা ফাতিহা অর্থ সহ, সূরা ফাতিহা বাংলা, সূরা ফাতিহার অর্থ, সূরা ফাতিহা আরবি, সূরা ফাতিহার ফজিলত, সূরা আল ফাতিহার তাফসীর, সূরা আল ফাতিহা ব্যাখ্যা, সূরা ফাতিহা বাংলা অনুবাদ, সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত, সূরা ফাতিহা ও সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, সূরা ফাতিহা সম্পর্কে হাদিস,সূরা আল ফাতিহা ব্যাখ্যা, সূরা ফাতিহার ফজিলত, سورة الفاتحة, সূরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, সূরা আল ফাতিহার শানে নুযুল, সূরা ফাতিহা এর তাফসীর, সূরা ফাতিহার ফজিলত ও আমল, সূরা ফাতিহা, সূরা ফাতিহা বাংলা তাফসীর, সূরা আল ফাতিহা বাংলা অর্থসহ pdf, সূরা ফাতিহার শেষ দুই আয়াত, সূরা আল ফাতিহা সকল রোগের ঔষধ, সূরা ফাতিহা pdf,সূরা ফাতিহার দারস, স্বপ্নে সূরা ফাতিহা পড়তে দেখলে কি হয়, রোগ নিরাময়ে সূরা ফাতিহার ফজিলত,৪১ বার সূরা ফাতিহা, সূরা আল ফাতিহা বাংলা অর্থ, সূরা আল ফাতিহা বাংলা অনুবাদ সহ, সূরা ফাতিহা সম্পর্কে হাদিস, সূরা ফাতিহার তাফসীর pdf, সূরা আল ফাতিহা বাংলা তাফসীর pdf, সূরা আল ফাতিহার উপকারিতা,সূরা ফাতিহা বাংলা উচ্চারণ ছবি, সূরা ফাতিহা পিকচার, সূরা ফাতিহার শিক্ষা, সূরা ফাতিহা কোথায় অবতীর্ণ হয়, ফরজ নামাজে সূরা ফাতিহা পড়ার নিয়ম, সূরা ফাতিহা আরবি, সূরা আল ফাতিহার জবাবে আল্লাহ কি বলেন, সূরা ফাতিহা নাযিলের প্রেক্ষাপট, সূরা আল ফাতিহা উচ্চারন, সূরা আল ফাতিহার সংক্ষিপ্ত তাফসীর, সূরা আল ফাতিহা আয়াত কয়টি, সূরা ফাতিহার আমল,Sura fatiha, sura fatiha er ortho, surah fatiha, surah fatiha bangla, surah fatiha bangla meaning, surah fatiha english translation, surah fatiha arabic text, surah fatiha in english, surah fatihah, surah fatiha with bangla translation,سورة الفاتحة للاطفال, سوره الفاتحه, سورة الفاتحه, عدد ايات سورة الفاتحة, كم عدد آيات سورة الفاتحة,

সূরা আল ফাতিহা এর পরিচয় :

সূরার নাম : সূরা আল ফাতিহা।সূরার অর্থ : শুরু।
সূরা নং : ১রুকু সংখ্যা : ১
আয়াত সংখ্যা : ৭সিজদা সংখ্যা : ০
শব্দ সংখ্যা : ২৫পারার সংখ্যা : ১
অক্ষর সংখ্যা : ১১৩শ্রেণী : মাক্কী।

সূরা ফাতিহা سورة الفاتحة Surah Fatiha এর তাফসির ও শানে নুযুল


بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

শুরু করছি আল্লাহ তা’আলার নামে, যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু ।

(١) الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

উচ্চারণ : আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল ‘আ -লামি-ন।

(১) যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার, যিনি সকল সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা।

(٢) الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ

উচ্চারণ : আররহমা-নির রাহি-ম।

(২) যিনি পরম করুণাময় অতি দয়ালু।

(٣) مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ

উচ্চারণ : মা-লিকি ইয়াওমিদ্দি-ন।

(৩) যিনি বিচারদিনের মালিক।

(٤) إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

উচ্চারণ : ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কা নাসতাঈ’-ন

(৪) আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি ।

(٥) اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

উচ্চারণ : ইহদিনাস সিরা-তাল মুসতাকিম

(৫) আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।

(٦) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ

উচ্চারণ : সিরা-তাল্লা যিনা আনআ’মতা আ’লাইহিম

(৬) সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নিয়ামত দান করেছ।

(٧) غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ

উচ্চারণ : গাইরিল মাগদুবি আ’লাইহিম ওয়ালা দ্দ-ল্লি-ন।

(৭) তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

সূরা আল ফাতিহা এর সূরার নামকরণ

الفتح অর্থ : খোলা, সূচনা বা আরম্ভ করা। الفاتحة অর্থ: উপক্রমণিকা। কুরআনে কারীমের সূরাসমূহের ধারাবাহিক ক্রমানুসারে এ সূরাটি প্রথম এবং এর মাধ্যমে কুরআন সূচনা করা হয় । তাই এর নাম সূরায়ে ফাতিহা বা কুরআনের উপক্রমণিকা। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের গবেষণামতে, অবতরণের দিক দিয়েও পূর্ণাঙ্গ সূরারূপে এটিই প্রথম। সূরা আলাক্ব, মুয্যাম্মিল ও মুদ্দাসসিরের কিছু আয়াত সূরা ফাতিহার আগে অবতীর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গ সূরারূপে এ সূরার অবতরণই প্রথম । এ জন্যই এ সূরার নাম ‘ফাতিহাতুল কিতাব’ বা কুরআনের উপক্রমণিকা রাখা হয়েছে। এ সূরা কুরআনে কারীমের মৌলিক বিষয়সমূহের সারসংক্ষেপ। তাই এ সূরার একটি নাম ‘উম্মুল কুরআন’ ও ‘উম্মুল কিতাব’ বা কুরআনের মূল। এ সূরাকে ‘আস সাবউল মাসানী বলেও অভিহিত করা হয়। আল ইতক্বান গ্রন্থে এ সূরার বিশোর্ধ্ব নাম উল্লেখ করেছে।

সূরা আল ফাতিহা এর আলোচ্য বিষয়

সূরা ফাতিহার আয়াত সংখ্যা সাত। প্রথম তিন আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠতম গুণাবলির বিবরণ । মাঝের চতুর্থ আয়াতে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের মূলনীতি আর শেষ তিন আয়াতে বান্দার পক্ষ হতে আল্লাহর প্রতি মৌলিক আবেদন-পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। বস্তুত মহান আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলির প্রতি আস্থা প্রকাশ, প্রশংসা করা, পরকালের প্রতি ঈমান গ্রহণ করা, একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা, তাঁরই নিকট সাহায্য চাওয়া, তাঁরই নিকট হিদায়াত প্রার্থনা করা এবং যাবতীয় ভ্রষ্টতা থেকে মুক্তির জন্য কেবল তাঁর নিকট আবেদন করার শিক্ষা এই সূরায় প্রদান করা হয়েছে।

আসলে সূরাটি একটি দোয়া বিশেষ। কুরআনের শুরুতে এই সূরাটি স্থান দেওয়ার অর্থই হচ্ছে, যদি কেউ এই কিতাব থেকে লাভবান হতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই উভয় জাহানের মালিক আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। সাথে সাথে সূরার শেষান্তে বলে দেওয়া হয়েছে, সত্য পথের সন্ধান এবং ভ্রষ্টতা থেকে পরিত্রাণ দেওয়াই এ কিতাব অবতরণের মূল লক্ষ্য।

সূরা ফাতিহা এর তাফসীর

আয়াত-১
الْحَمْدُ لِلَّهِ যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য। পৃথিবীর যেকোনো স্থানে যেকোনো বস্তুর প্রশংসা হলে বাস্তবে তা আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা কোনো বস্তুর প্রশংসা প্রকৃতপক্ষে উক্ত বস্তুর সৃষ্টিকর্তারই প্রশংসা। এ বাক্যটি মানুষের কাছে বাস্তবতার নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, আমাদের সামনে যা কিছু রয়েছে এ সব কিছুই সৃষ্টিগতভাবে এক একক সত্তার সাথে জড়িত। তাই সব প্রশংসাই সেই অনন্ত অসীম সত্তার জন্য । আর উপাসনার উপযুক্তও একমাত্র তিনিই। এ সব দেখার পরও যদি অপর কাউকে প্রশংসা ও উপাসনার প্রাপ্য বলে কারো অন্তরে উদ্রেক হয়, তবে এ ধারণা জ্ঞান-বুদ্ধির সংকীর্ণতারই পরিচায়ক। অতএব এ বাক্যে আল্লাহর প্রশংসার সাথে সাথে একত্ববাদের শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো প্রকৃতপক্ষে সব প্রশংসার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তা’আলা।

এ বাক্যটিতে যে দাবি করা হয়েছে এর সপক্ষে দলিল হিসেবে আল্লাহর গুণবাচক নাম رَبِّ الْعَالَمِينَ (যিনি সব সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা) উল্লেখ করা হয়েছে। رَبِّ শব্দের অর্থ হচ্ছে পালনকর্তা। কোনো বস্তুকে তার সমস্ত কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে পর্যায়ক্রমে লালন-পালন করে যে সামনে এগিয়ে নেয় তাকে رَبِّ (পালনকর্তা) বলা হয় । রূপক অর্থে কাউকে রব বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ও সাধারণভাবে একমাত্র আল্লাহই রব ।

الْعَالَمِينَ শব্দটি عَالَمِ-এর বহুবচন। গোটা পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টিই এর অন্তর্ভুক্ত। অতএব, رَبِّ الْعَالَمِينَ -এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা সমস্ত সৃষ্টির পালকর্তা। যেহেতু তিনি সমগ্র সৃষ্টির লালন-পালন করেন তাই প্রশংসারও প্রকৃত প্রাপক তিনিই। অন্য কেউ নয়। সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে, সব প্রশংসার প্রকৃত প্রাপক যিনি, সব উপাসনার অধিকারীও তিনি। এর মাধ্যমে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে কুরআনে কারীমের প্রথম আয়াতটিতে আল্লাহর একত্ববাদের শিক্ষাও প্রদান করা হয়েছে।

আয়াত-২
الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ আল্লাহ তা’তালার শ্রেষ্ঠতম দুটি গুণবাচক নাম। উভয় শব্দই আল্লাহ তা’আলার গুণের আধিক্যবোধক বিশেষণ, যাতে তাঁর দয়া ও করুণার অসাধারণত্ব ও পূর্ণতার কথা বোঝায়। এখানে এই বিশেষণ দ্বারা ইঙ্গিত করা হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা যে সমগ্র সৃষ্টিজগতের লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং গ্রহণ করেছেন এতে তাঁর নিজস্ব কোনো প্রয়োজন নেই বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও তিনি তা করেননি। বরং তাঁর রহমত ও দয়ার তাগিদেই করেছেন। তাই সমগ্র সৃষ্টির অস্তিত্বও যদি না থাকে, তাতেও তাঁর কোনো লাভ-ক্ষতি নেই। আর যদি সবাই তাঁর অবাধ্যও হয়ে যায় তবে তাতেও তাঁর কোনো উপকার-অপকার নেই । তিনি অমুখাপেক্ষী । এ সৃষ্টিজগৎ কেবল তাঁর দয়ার ফসল । অতএব, তিনি সব প্রশংসার মালিক। তিনিই উপাস্য হওয়ার একমাত্র অধিকারী ।

বি.দ্র. : আল্লাহ তা’আলার বিশেষণ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ দুটির মধ্যে তাফসীরকারকগণ বিভিন্ন ব্যবধান বর্ণনা করেছেন। উদারহণ স্বরূপ الرَّحْمَـٰنِ বিশেষণটি সকল সৃষ্টিজগতের প্রতি ব্যাপকভাবে দয়া প্রদর্শনের অর্থে ব্যবহৃত হয় । যেমন—তিনি সব কিছু দয়া ও অনুগ্রহ করে সৃষ্টি করেছেন, লালন-পালন করেন, খাদ্য প্রদান করেন ইত্যাদি। আর الرَّحِيمِ বিশেষণটি শুধু মুমিনদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন-মুমিনদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন, তাদের পাপ ক্ষমা করা, পরকালে চিরশান্তি ও অশেষ নিয়ামত দান করা ইত্যাদি ।

আল্লামা তাকী উসমানি দা. বা. বলেন, আরবী নিয়ম অনুসারে, رحْمَـٰنِ সেই সত্তা, যাঁর রহমত ও দয়া অত্যন্ত ব্যাপক (Extensive), যা দ্বারা সবাই উপকৃত হয় । আল্লাহ তা’আলা হিসেবে দুনিয়ায় তাঁর দয়া সবাই ভোগ করে। আর الرَّحِيمِ সেই সত্তা, যাঁর রহমত খুব বেশি এবং যাঁর প্রতি রহমত হয় পরিপূর্ণরূপে। (Intensive) আল্লাহ তা’আলা الرَّحِيمِ বিশেষণের ভিত্তিতে পরকালে শুধুই মুমিনদের প্রতি দয়া করবেন, তবে পরিপূর্ণরূপে দয়া হবে। ফলে, সেখানে নিয়ামতের কোনো কমতি বা অপূর্ণতা থাকবে না। তাই দুটি শব্দের মৌলিক পার্থক্য হিসেবে الرَّحْمَـٰنِ এর অর্থ: তিনি সবার প্রতি দয়াবান বা পরম করুণাময় আর الرَّحِيمِ -এর অর্থ: অতি দয়ালু। আসমায়ে হুসনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

আয়াত-৩
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ বাক্যটিতে مَالِكِ -এর অর্থ হলো, কোনো বস্তুর ওপর কারো এমন অধিকার থাকা, যাকে ব্যবহার, পরিবর্তন, পরিবর্ধন-সব কিছু করার অধিকার তার থাকবে । دينِ শব্দটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থে আসে। এখানে প্রতিদান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ এর আভিধানিক অর্থ: প্রতিদান দিবসের অধিপতি বা বিচার দিনের মালিক। তাফসীরে কাশশাফে আছে; সেদিন কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নয়, বরং ব্যাপকভাবে সব সৃষ্টিরাজি ও সব বিষয়ই আল্লাহ তা’আলার অধিকারে থাকবে, অধীনে থাকবে। সেদিন সব বান্দাকে পার্থিব জীবনের যাবতীয় কৃতকর্মের প্রতিফল প্রদান করা হবে।

এ আয়াতে রহস্যপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহ তা’আলার মালিকানা ও আধিপত্য কেবলমাত্র প্রতিদান দিবসেই নয়, বরং গোটা পৃথিবীতেও সমস্ত সৃষ্টজগতের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা’আলা । তবে এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা প্রতিদান দিবসের মালিক উল্লেখ করার তাৎপর্য কী? আল কুরআনের অন্যান্য আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, যদিও দুনিয়াতেও সব কিছুর প্রকৃত মালিকানা আল্লাহ তা’আলার জন্য, কিন্তু তিনি অনুগ্রহ করে আংশিক ও ক্ষণস্থায়ী মালিকানা মানবজাতিকেও দান করেছেন।

আল্লাহ তা’আলা مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ (প্রতিদান দিবসের মালিক) এ কথা ঘোষণা করে অহংকারী ও নির্বোধ মানব সমাজকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তোমাদের এ মালিকানা ও আধিপত্য মাত্র কয়েক দিনের জন্য ক্ষণস্থায়ী। এমন দিন অতিসত্বরই আসছে, যেদিন কারো বাহ্যিক মালিকানাও থাকবে না। সেদিন সব বস্তুর মালিকানা এক ও একক সত্তার হয়ে যাবে। সেদিন হবে প্রতিদান দিবস। তা বোঝানোর জন্যই এ আয়াতে বিশেষভাবে আল্লাহ তা’আলা প্রতিদান দিবস বা কর্মফল দিবসের মালিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আয়াত-৪
عبادة -نَعْبُدُ শব্দ থেকে গঠিত। অর্থ: কারো প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দরুন তাঁর প্রতি নিজের আন্তরিক মিনতি প্রকাশ করা।

نَسْتَعِينُ শব্দটি استعان হতে গঠিত। অর্থ: কারো সাহায্য প্রার্থনা করা। আয়াতের মর্ম হচ্ছে, বান্দার পক্ষ থেকে মহান প্রভুর প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করা হচ্ছে ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি ।

উল্লেখ্য যে, সূরা ফাতিহার প্রথম তিনটি আয়াতে এ আলোচনা হয়েছে যে, প্রশংসার প্রাপক একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। আমাদের ওপর তাঁর অশেষ করুণা রয়েছে। তিনি আমাদের দয়া করে লালন-পালন করেন। ভবিষ্যতে প্রতিদান দিবসেও তিনি হবেন সব কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি। তাই স্বাভাবিক বিবেকের চাহিদা হলো, ইবাদত উপাসনাও একমাত্র তাঁরই করতে হবে এবং তিনি ছাড়া বাস্তবে সাহায্য পূরণ করার উপযুক্ত আর কেউ হতে পারে না। বান্দার অভাব ও চাহিদা পূরণ করার মতো আর কেউ নেই । অন্য কারো নিকট প্রার্থনার হাত প্রসারিত করা যাবে না। ইহ ও পরকালের কোনো বিষয়েই নয়; বরং প্রতিটি মানুষের সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা এমন হতে হবে যে, আমি আমার ইবাদত-উপাসনা এবং যাবতীয় ধর্মীয় ও পার্থিব কাজে কেবল তারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

আয়াত-৫. ৬. ৭
শেষ তিনটি আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সাধারণ মানুষ, মুমিনগণ, অলি-আউলিয়া, গাউস-কুতুব এবং নবী-রাসূল সবাইকে তাঁর নিকট বিশেষ পদ্ধতিতে আবেদন ও প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছেন। اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (আমাদেরকে সরল পথ দেখিয়ে দিন) এটি একটি ব্যাপক ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দোয়া। মানব সমাজের কোনো ব্যক্তিই এর আওতার বাইরে নেই। অবশ্য হিদায়াত বা সরল পথের বিভিন্ন স্তর আছে। একটি স্তর হলো, গন্তব্য স্থানের প্রতি পথ প্রদর্শন করা। আরেকটি স্তর হলো, গন্তব্য স্থানে সরাসরি পৌছিয়ে দেওয়া। বস্তুত প্রতিটি সৃষ্টিই স্ব-স্ব পরিমণ্ডলে আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত বা সরল পথ পাওয়ার মুখাপেক্ষী। কেননা, সরল সঠিক পথ ব্যতীত ইহ ও পরকাল কোনোটিরই উন্নতি ও সাফল্য কখনো সম্ভব নয়। (মুফরাদাতুল কুরআন, রাগেব)

সরল পথ কোনটি?
সরল-সোজা রাস্তা সে পথকে বলে, যাতে কোনো মোড় বা ঘোরপ্যাঁচ নেই। ইসলামী পরিভাষা হিসেবে সরল পথ হচ্ছে, ধর্মের সে রাস্তা, যাতে ইফরাত ও তাফরীত তথা বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি নেই। মোটকথা, কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পথই সরল পথ । সহজে সরল পথের পরিচয় হিসেবে মহান আল্লাহ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের পথকে সরল পথ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ঘোষণা করেন-

إهدنا القيراط المستقيم . متراط الذين أنعمت عليهم
(আমাদের সরল পথ দেখিয়ে দিন। যেসব লোক আপনার অনুগ্রহ লাভ করেছে তাদের পথ ।) যে সকল ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করেছেন, তাঁদের পরিচয় অন্য একটি আয়াতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে :

الذين أنعم الله عليهم من التبين و الصديقين والشهداء والصلحين
‘যাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলা অনুগ্রহ করেছেন, তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহীন-সৎকর্মশীল।’ (সূরা আন নিসা-৬৯)

মোটকথা, যেসব লোক আপনার অনুগ্রহ লাভ করেছেন, তাঁদের রাস্তা বলে ইতিবাচকভাবে চার স্তরের মানুষ যে পথে চলেছেন, সে পথ বুঝিয়েছেন। তাই নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীল—এই চার স্তরের মানুষের পথ হলো সরল পথ। এই সরল পথে পরিচালনার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন। পরের আয়াতে নেতিবাচকভাবে সরল পথের পরিচয় হিসেবে দুই ধরনের ভ্রান্ত পথ থেকে মুক্তি কামনা করার শিক্ষা দিয়েছেন।
ঘোষণা করেন, غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ তাদের পথে নয়, যাদের প্রতি তোমার ক্রোধ রয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ বলতে ওই সব লোক, যারা ধর্মীয় বিধান বোঝে ও জানে, কিন্তু অহমিকা ও ব্যক্তি স্বার্থের বশবর্তী হয়ে বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হয়েছে অথবা অবহেলা-গাফিলতি করেছে। এদের অন্যতম হলো ইহুদি সম্প্রদায়। তারা সত্য বিষয় জেনে-বুঝেও তাদের নবীদের অমান্য করেছে। হত্যা করেছে। নবী মুহাম্মাদ স.-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। জয় বলতে ওই সব লোক উদ্দেশ্য, যারা না বুঝে অজ্ঞতার দরুন ধর্মীয় ব্যাপারে ভুল পথের অনুসারী হয়েছে এবং সীমালঙ্ঘন করেছে। এদের অন্যতম হলো নাসারা-খ্রিস্টান সম্প্রদায়। তারা না বুঝে ধর্মের নামে অতি বাড়াবাড়ি করে নবীগণ আ.-কে আল্লাহর স্থানে উপনীত করে দিয়েছে। স্বার্থের বশবর্তী হয়ে বিরুদ্ধাচরণ এবং ধর্মের নামে সীমালঙ্ঘন করেছে। আর এই দুইয়ের মধ্যবর্তী হলো সহজ-সরল পথ।

সারমর্ম

ইতিবাচকভাবে নবী, সিদ্দিক, শহিদ ও সৎকর্মশীল—এই চার স্তরের মানুষের পথ হলো সরল পথ। আর নেতিবাচকভাবে যাদের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ রয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের পথ বর্জন করা হলো সরল পথ। আর সূরা ফাতিহার মধ্যে এই দোয়াই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, ‘হে আল্লাহ! আমাদের সরল পথ প্রদর্শন করুন’ কেননা, সরল পথের সন্ধান লাভই সর্বাপেক্ষা বড় সফলতা। এ পথের সন্ধানে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই বিভিন্ন জাতি ও জনপদ ধ্বংস হয়েছে। তাই কুরআনে কারীমের প্রারম্ভিকায় আল্লাহ তা’আলা ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় পদ্ধতিতে সীরাতে মুসতাকীম বা সরল পথের পরিচয় তুলে ধরেছেন। امين শব্দটি দোয়ার শব্দ। এর অর্থ: হে আল্লাহ কবুল করুন। এ শব্দটি সূরা ফাতিহার অংশ নয়। কুরআনে কারীমের কোথাও তা উল্লেখ নেই। নামাযে অথবা নামাযের বাইরে সূরা ফাতিহা শেষান্তে আমিন বলা সুন্নত।

নির্দেশনা

১. আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রশংসা করা পছন্দ করেন। তাই তিনি স্বয়ং তাঁর প্রশংসা করেছেন এবং বান্দাদেরকে প্রশংসা শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ, তিনিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য এবং ইবাদতের উপযুক্ত ও সাহায্যকারী।
২. প্রকৃত প্রশংসার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই । আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট সাহায্য চাওয়ার যৌক্তিকতা নেই। কারো কাছে এমন যোগ্যতাও বিদ্যমান নেই। কেননা, একমাত্র তিনিই রাহমান, রাহীম, প্রতিদান দিবসের মালিক-অধিপতি। এমন মহৎগুণের অধিকারী ব্যতীত প্রশংসার দাবি করা অবান্তর, সে কখনো ইবাদতের উপযুক্ত হতে পারে না, তার কাছে সাহায্য চাওয়ার যৌক্তিকতা নেই।

৩. দোয়া করার অন্যতম একটি আদব হলো, আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা ও গুণাগুণের মাধ্যমে তা আরম্ভ করা।
৪. সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দোয়া আল্লাহর কাছে সরল পথ প্রার্থনা করা।
৫. সরল পথের সহজ পরিচয় হলো, আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তদের পথে চলা এবং অবিচল থাকা।

আরো পড়ুন :

৭৯.সূরা নাযিয়াত سورة النازعات Surah An Naziat এর তাফসির ও শানে নুযুল

৮০.সূরা আবাসা سورة عبس Surah Abasa এর তাফসির ও শানে নুযুল

৮১.সূরা আত তাকভীর سورة التكوير Surah At Takwir এর তাফসির ও শানে নুযুল

ট্যাগ সমূহ : সূরা আল ফাতিহার সানে নুযুল,সূরা ফাতিহার তাফসীর,সূরা ফাতিহা,সূরা ফাতিহা বাংলা অর্থ,সূরা ফাতিহা বাংলা উচ্চারণ, সূরা ফাতিহার শানে নুযুল, সূরা ফাতিহা অর্থ, সূরা ফাতিহা অর্থ সহ, সূরা ফাতিহা বাংলা, সূরা ফাতিহার অর্থ, সূরা ফাতিহা আরবি, সূরা ফাতিহার ফজিলত, সূরা আল ফাতিহার তাফসীর, সূরা আল ফাতিহা ব্যাখ্যা, সূরা ফাতিহা বাংলা অনুবাদ, সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত, সূরা ফাতিহা ও সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, সূরা ফাতিহা সম্পর্কে হাদিস,সূরা আল ফাতিহা ব্যাখ্যা, সূরা ফাতিহার ফজিলত, سورة الفاتحة, সূরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, সূরা আল ফাতিহার শানে নুযুল, সূরা ফাতিহা এর তাফসীর, সূরা ফাতিহার ফজিলত ও আমল, সূরা ফাতিহা, সূরা ফাতিহা বাংলা তাফসীর, সূরা আল ফাতিহা বাংলা অর্থসহ pdf, সূরা ফাতিহার শেষ দুই আয়াত, সূরা আল ফাতিহা সকল রোগের ঔষধ, সূরা ফাতিহা pdf,সূরা ফাতিহার দারস, স্বপ্নে সূরা ফাতিহা পড়তে দেখলে কি হয়, রোগ নিরাময়ে সূরা ফাতিহার ফজিলত,৪১ বার সূরা ফাতিহা, সূরা আল ফাতিহা বাংলা অর্থ, সূরা আল ফাতিহা বাংলা অনুবাদ সহ, সূরা ফাতিহা সম্পর্কে হাদিস, সূরা ফাতিহার তাফসীর pdf, সূরা আল ফাতিহা বাংলা তাফসীর pdf, সূরা আল ফাতিহার উপকারিতা,সূরা ফাতিহা বাংলা উচ্চারণ ছবি, সূরা ফাতিহা পিকচার, সূরা ফাতিহার শিক্ষা, সূরা ফাতিহা কোথায় অবতীর্ণ হয়, ফরজ নামাজে সূরা ফাতিহা পড়ার নিয়ম, সূরা ফাতিহা আরবি, সূরা আল ফাতিহার জবাবে আল্লাহ কি বলেন, সূরা ফাতিহা নাযিলের প্রেক্ষাপট, সূরা আল ফাতিহা উচ্চারন, সূরা আল ফাতিহার সংক্ষিপ্ত তাফসীর, সূরা আল ফাতিহা আয়াত কয়টি, সূরা ফাতিহার আমল,Sura fatiha, sura fatiha er ortho, surah fatiha, surah fatiha bangla, surah fatiha bangla meaning, surah fatiha english translation, surah fatiha arabic text, surah fatiha in english, surah fatihah, surah fatiha with bangla translation,سورة الفاتحة للاطفال, سوره الفاتحه, سورة الفاتحه, عدد ايات سورة الفاتحة, كم عدد آيات سورة الفاتحة,

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top