সূরার পরিচয় :
সূরার নাম : সূরা আছর | সূরার অর্থ : যুগ বা সময়। |
সূরা নং : ১০৩ | রুকু সংখ্যা : ১ |
আয়াত সংখ্যা : ৩ | সিজদা সংখ্যা : ০ |
শব্দ সংখ্যা : ১৪ | পারার সংখ্যা : ৩০ |
অক্ষর সংখ্যা : ৬৮ | শ্রেণী : মাক্কী |
১০৩.সূরা আছর سورة العصر Sura Asr এর তাফসির ও শানে নুযুল
بسم الله الرحمن الرحيم ”শুরু করছি আল্লাহ তা’আলার নামে, যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।” |
(١)- وَٱلْعَصْرِ (১) কসম যুগের (সময়ের)। |
(٢)- إِنَّ ٱلْإِنسَٰنَ لَفِى خُسْرٍ (২) নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। |
(٣)- إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلْحَقِّ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلصَّبْرِ (৩) কিন্তু তারা নয়; যারা বিশ্বাস স্থাপন ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের ও সবরের তাকিদ করে। |
শাব্দিক বিশ্লেষণ
وَٱلْعَصْرِ : যুগ, কাল সময়। এর সঙ্গে নির্দিষ্ট অর্থ বোঝাতে ال (টি) শুরুতে কসম বা শপথ বোঝাতে و (শপথ) অব্যয় এসেছে। وَٱلْعَصْرِ অর্থ: কালের শপথ ।
خُسْرٍ : (ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, ধ্বংস হওয়া)। আর এর পূর্বে ل ক্রিয়া বিশেষণ এবং অব্যয় فى থাকায় অর্থ হয়েছে অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে আছে।
ٱلصَّٰلِحَٰتِ : বিশেষ্য, স্ত্রীলিঙ্গ বহুবচন। একবচন الصالحة (সৎকর্ম, নেকীর কাজ, কুরআন ও হাদীসের অনুমোদিত কাজসমূহ) এর মূল হলো صلح (সৎ হওয়া, সৎকর্মশীল হওয়া)।
وَتَوَاصَوْا۟ : শব্দটির মূল হলো وصى (যুক্ত করা, যুক্ত হওয়া) আর وَتَوَاصَوْا۟ অর্থ: পরস্পর পরস্পরকে পরামর্শ দেয়। ক্রিয়া, অতীতকাল, প্রথম পুরুষ, পুংলিঙ্গ, বহুবচন।
আলোচ্য বিষয়
সূরা আছরে মানুষের সাফল্য ও কল্যাণ এবং তার ধ্বংস ও সর্বনাশের পথ বর্ণনা করা হয়েছে। সফলতা অর্জনের উপায় হিসেবে চারটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। ঈমান গ্রহণ, সৎ কর্ম, অপরকে সত্যের উপদেশ প্রদান এবং বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করা।
সুরা আছর এর শানে নুযুল
ওলীদ ইবনে মুগিরা, আস ইবনে ওয়াইল, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব প্রমুখ বলতেন যে, মুহাম্মদ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে (তাদের কথার অসারতা প্রমাণ করে) আল্লাহ সূরাটি নাযিল করেন।
জাহিলিয়া যুগে আবু বকর সিদ্দিকের সাথে কালাদাহ ইবনে উসায়েদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কালাদাহ প্রায়ই তার নিকট যাতায়াত করতো।
আবু বকর ইসলাম গ্রহণের পর একদিন সে তার নিকট এসে বললো, “হে আবু বকর! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? ব্যবসা-বাণিজ্যে তো ভাটা লেগেছে। আয়-রোজগারের পথ তো প্রায় বন্ধ। তুমি কোন ধারণায় নিমজ্জিত হয়েছো ? নিজেদের ধর্মকর্মও হারিয়েছ এবং দুনিয়াও হারিয়েছ। তুমি এখন উভয় দিক দিয়ে পূর্ণরূপে লোকসানে নিপতিত।”
আবু বকর বললেন, “হে নির্বোধ! যে লোক আল্লাহ তাআলা ও তার রাসুলের গোলাম হয়ে যায়, সে কখনো লোকসানে নিপতিত হয় না। যারা পরকাল সম্পর্কে কোনই চিন্তাভাবনা করে না মূলত তারাই ক্ষতিগ্রস্ত, তারাই লোকসানে নিপতিত। যারা কেবল জাগতিক উন্নতি লাভের জন্যই সদা চিন্তামগ্ন ও ব্যস্ত থাকে, তারাই একূল-ওকূল উভয় কূলই হারায়।”
আবু বকরের কথার সত্যতা প্রমাণ এবং এ ঘটনাকে উপলক্ষ করে এ সূরা অবতীর্ণ হয়।
সূরা আছর এর তাফসীর
আয়াত-১.
সময়ের শপথ করে আল্লাহ বলেন, উন্নত গুণ এবং সৌভাগ্য অর্জনের জন্য সময়কে মহামূল্যবান সুযোগ মনে করা উচিত। অথবা عصر দ্বারা এখানে আসর নামায উদ্দেশ্য وَٱلْعَصْرِ আসরের নামাযের সময়ের শপথ। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে আছরের সময়টি কাজ-কারবারের সময় হওয়ায় আসরের নামায ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এ সময়ের গুরুত্ব অনেক। অথবা আয়াতে রাসূলুল্লাহ স.-এর বরকতময় যুগের শপথ করা হয়েছে।
আয়াত-২.
যারা পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা না করে কাজ করে ব্যর্থতা তাদের পিছু ছাড়ে না। মানুষের উচিত সময়ের মূল্য অনুধাবন করা এবং জীবনের মুহূর্তগুলোকে উদাসীনতায় নষ্ট না করা । যে সময়গুলো মূলত সম্মান লাভ এবং শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সুযোগ সে সময়টিকে যদি অবহেলায় নষ্ট করা হয় তাহলে বুঝতে হবে মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কল্পনা করা যায় না। সুতরাং সৌভাগ্যবান তারাই যারা সফলতা অর্জনের চেষ্টায় তৎপর থাকে।
আয়াত-৩.
তবে যারা চারটি কাজ করতে পেরেছে তারা সফলকাম।
১. যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স.-এর প্রতি এবং রাসূল স. যে হেদায়াত এনেছেন তাঁর প্রতি ।
২. নেক আমল তথা কথা ও কাজে কুরআন-সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরণ করেছে।
৩. একে অপরকে সত্য ও ন্যায়ের উপদেশ দিয়েছে।
৪. এবং পরস্পর সকল প্রকার বিপদাপদে এবং হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ বর্জনে ধৈর্যধারণের উপদেশ দিয়েছে । যারা এই চারটি গুণ অর্জন করতে পারে তারাই সকল প্রকার ক্ষতি থেকে মুক্ত ।
সময়ের শপথ করার রহস্য :
وَٱلْعَصْرِ শব্দের অর্থ: সময় বা যুগ। এ তাফসীরই বেশি প্রাধান্যযোগ্য। মহান প্রভু যুগের শপথ করে বলেছেন উল্লিখিত চারটি গুণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। প্রশ্ন হয় যে, উল্লিখিত বিষয়বস্তুর সাথে যুগের কী সম্পর্ক, যার শপথ করা হয়েছে? অধিকাংশ তাফসীরবিদগন বলেন, মানুষের কর্ম গতিবিধি ও উঠা বসা ইত্যাদি সব যুগের মধ্যেই সংঘটিত হয়।
আর এ সূরায় যে চারটি বিষয়ের আলোচনা হয়েছে সেগুলোও এই যুগ-কালেরই দিবা-রাত্রিতে সংঘটিত। ভালো-মন্দ সব কর্মের সাক্ষী যেন এই যুগ কাল ও সময়। এই প্রেক্ষিতে যুগের শপথ করা হয়েছে আরেকটি বিষয় চিন্তা করলে দেখা যায়, সময় হলো মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ সব অর্জনের মূল পুঁজি । মানুষ যাবতীয় ক্ষতি থেকে বাঁচা ও চারটি কাজ করে সফলতা অর্জনের জন্যে এই যুগ ও সময়কে অপচয় না করে পুঁজি হিসেবে মূল্যায়ণ করার প্রতি ইঙ্গিত করার লক্ষ্যে সময় বা যুগের শপথ করা হয়েছে।
সফলতার চারটি কাজের বিশ্লেষণ :
ঈমান গ্রহণ ও সৎ কর্ম করা এ দুটি কাজ হলো ব্যক্তিগত আত্মসংশোধনমূলক বিষয়। এ ছাড়া দুটি কাজ হলো, সত্যের উপদেশ ও সবরের উপদেশ করা, এ দুটি বিষয়ে বলা হয়েছে, وَتَوَاصَوْا۟ (পরস্পর উপদেশ দাও) এ শব্দটি وصيت থেকে উদ্ভূত। কাউকে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে উপদেশ দেওয়া ও সৎ কাজের জোর তাকীদ করার নাম অসিয়ত। এ কারণেই মরণোন্মুখ ব্যক্তি পরবর্তীকালের জন্য যেসব নির্দেশ দেয়, তাকেও অসিয়ত বলা হয়। উপরোক্ত দুই রকম উপদেশ প্রকৃতপক্ষে এই অসিয়তেরই দুটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায় সত্যের উপদেশ এবং দ্বিতীয় অধ্যায় সবরের উপদেশ। তখন এ দুটি শব্দের কয়েক রকম অর্থ হতে পারে-
এক. সত্যের অর্থ বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও সৎ কর্মের সমষ্টি। আর সবরের অর্থ যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা। অতএব প্রথম শব্দের সারমর্ম হলো ‘আমর বিল মারুফ তথা সৎকাজের আদেশ করা’ এবং দ্বিতীয় শব্দের সারমর্ম হলো ‘নাহী আনিল মুনকার’ তথা মন্দ কাজের নিষেধ করা । এখন وتواصوا بالحق وتواصوا بالصبر , এর সমষ্টির সারমর্ম এই দাঁড়াল যে, নিজে যে ঈমান ও সৎ কর্ম অবলম্বন করেছে, অপরকেও তার উপদেশ প্রদান করো।
দুই. সত্যের অর্থ বিশুদ্ধ বিশ্বাস এবং সবরের অর্থ সৎ কাজ করা এবং মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকা। কেননা সবরের আক্ষরিক অর্থ নিজেকে বাধা দেওয়া ও আনুগত্য করা। এই আনুগত্য করার মধ্যে সৎ কর্ম সম্পাদন এবং গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা উভয়ই শামিল ।
উল্লেখ্য যে,নাজাতের জন্য শুধু নিজের কর্ম সংশোধিত হওয়াই যথেষ্ট নয়, অপরের জন্য চিন্তা করাও জরুরি। নিজের ধর্ম-কর্মকে কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী করে নেওয়া যতটা জরুরি ততটাই জরুরি অন্য মুসলমানকেও ঈমান ও সৎ কর্মের প্রতি আহ্বান করার সাধ্যমতো চেষ্টা করা। তবে নিজের চিন্তা ও নিজের সংশোধন প্রথমে করতে হবে। এ জন্যই উল্লিখিত সূরায় নিজের ঈমান ও আমল সংশোধনের বিষয়টা প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, قوا أنفسكم তোমরা নিজেদেরকে আগুন থেকে বাঁচাও । পরে নির্দেশ হয়েছে, وأهليكم এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন থেকে বাঁচাও। (সূরা আত তাহরীম-৬)
বর্তমানে অনেককেই অপরের বিষয়ে খুব ব্যস্ত ও চিন্তাশীল লক্ষ করা যায়। অথচ নিজের বেলায় উদাসীন। নিজের সন্তান, পরিবারের চিন্তা না করে অন্যদের জন্য কাতর। তাদের সম্পর্কে প্রখ্যাত কবি শেখ সাদী রহ. বলেছেন, তারা হলো ওই অন্ধ ব্যক্তির মতো যার হাতে বাতি আছে। লোকজন উপকৃত হচ্ছে, অথচ সে নিজে আলো পাচ্ছে না। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর নিজের চিন্তা জরুরি। তোমরা যদি সৎ পথে পরিচালিত হও (নিজের দায়িত্ব পালন করো এবং অন্যদের বাঁচানোর যথাযথ চিন্তাও করো) তাহলে কেউ পথভ্রান্ত হলে তাতে তোমাদের কোনো ক্ষতি নেই।’ (মায়িদাহ-১০৫)
এ বিষয়ে যুগশ্রেষ্ঠ দার্শনিক আল্লামা তাকী উসমানীর লেখা ‘আপন ঘর আগে বাঁচান’ প্রবন্ধটি অনেক তথ্যবহুল এবং ‘পারিবারিক ও সামাজিক সংঘাতের কারণ ও সমাধান’ এর সাথে সংযোজিত আছে। রচনাটি সর্বসাধারণের জন্য খুবই উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
নির্দেশনা
১. ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর ভাষায় যেকোনো মানুষ এই সূরাটিকে চিন্তা-ভাবনা সহকারে আমলের নিয়্যাতে পাঠ করলে তার ইহকাল ও পরকাল সংশোধনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায় ।
২. মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্প্রতি পূর্ণ হওয়া উচিত যে, তারা একে অপরকে সদা সত্য ও ন্যায়ের উপদেশ এবং সকল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেবে। কেননা নেক কাজে আল্লাহ ধৈর্যধারণকারীর সঙ্গী হওয়ার ওয়াদা করেছেন।
ট্যাগ সমূহ : সূরা আছর,سورة العصر,سورة العصر للاطفال, সূরা আছর বাংলা উচ্চারণ, সূরা আছর বাংলা অর্থ, সূরা আছর এর তাফসীর, সূরা আছর এর অনুবাদ, সুরা আছর বাংলা অনুবাদ সহ, সূরা আছর এর অর্থ, সূরা আছর বাংলা অনুবাদ, সুরা আছর এর শানে নুযুল, সূরা আছর এর দারস, সূরা আসর তাফসীর,Sura achor,sura acor,সূরা আছরের তফসির,সূরা আছর এর ফজীলত,Sura Asr,sura asr bangla,سوره العصر, সূরা আছর,سورة العصر,سورة العصر للاطفال, সূরা আছর বাংলা উচ্চারণ, সূরা আছর বাংলা অর্থ, সূরা আছর এর তাফসীর, সূরা আছর এর অনুবাদ, সুরা আছর বাংলা অনুবাদ সহ, সূরা আছর এর অর্থ, সূরা আছর বাংলা অনুবাদ, সুরা আছর এর শানে নুযুল, সূরা আছর এর দারস, সূরা আসর তাফসীর,Sura achor,sura acor,সূরা আছরের তফসির,সূরা আছর এর ফজীলত,Sura Asr,sura asr bangla,سوره العصر |
আরো পড়ুন :
১০৮.সূরা কাউসার سورة الكوثر Sura kawsar এর তাফসির ও শানে নুযুল
১০৯.সূরা কাফিরুন سورة الكافرون sura kafirun এর তাফসীর ও শানে নুযুল
আবু বকর রা. ঈমান গ্রহণের পর একদিন কালাদাহ ইবনে উসায়েদ তার নিকট এসে বললো, “হে আবু বকর! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? ব্যবসা—বাণিজ্যে তো ভাটা লেগেছে। আয়—রোজগারের পথ তো প্রায় বন্ধ। তুমি কোন ধারণায় নিমজ্জিত হয়েছো? নিজেদের ধর্মকর্মও হারিয়েছ এবং দুনিয়াও হারিয়েছ। তুমি এখন উভয় দিক দিয়ে পূর্ণরূপে ক্ষতিতে নিপতিত।”
আবু বকর সিদ্দীক রা. বললেন, “হে নির্বোধ! যে লোক আল্লাহ তা’আলা ও তার রাসুলের অনুগত হয়ে যায়, সে কখনো ক্ষতিতে নিপতিত হয় না। যারা পরকাল সম্পর্কে কোনই চিন্তাভাবনা করে না মূলত তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
আবু বকর রা. এর কথার সত্যতা প্রমাণ এবং এ ঘটনাকে উপলক্ষ করে এ সূরা অবতীর্ণ হয়। [তাফসীরে আযীযী’র রেফারেন্সে — শানে নুযূল (মুফতি জালালুদ্দিন)