শিরক হচ্ছে সকল পাপের চাইতে বড় পাপ। যা আল্লাহ তাআলা কখনোই ক্ষমা করবেন না। যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করে মারা যায় তাহলে তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকতে হবে। শিরকের ভয়াবহতা এত বেশি যে মানুষের সব আমল নষ্ট করে দেয়। মানুষকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়।
সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক : শিরক হলো জঘন্যতম গুনাহ। যার কোন ক্ষমা নেই। শিরক মিশ্রিত যে কোন আমল ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যহীন এবং আল্লাহর নিকটে তা প্রত্যাখ্যান। কেউ যদি জীবনে একটি শিরকও করে এবং তওবা না করে মৃত্যুবরণ করে তাহলে এই একটি মাত্র শিরকই তার ঈমান ও জীবনের যাবতীয় সৎকর্ম নিষ্ফল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“বলুন, আমি তোমাদেরকে কি সংবাদ দেব নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ? তারা সেসব লোক দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্ঠা সাধনা ব্যর্থ হয়ে গেছে আর তারা নিজেরা মনে করছে যে, তারা সৎকর্ম করছে” (সূরা কাহাফ : ১০৩-১০৪)
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন :
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তার সাথে শিরকের অপরাধ ক্ষমা করবেন না। আর ইহা ব্যতীত যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন।” (সূরা নিসা : ৪৮)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন,
“(হে নবী) কিন্তু তোমার কাছে আর তোমাদের পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী করা হয়েছে যে, তুমি যদি আল্লাহর সাথে শরিক স্থির কর, তাহলে তোমার কর্ম অবশ্যই নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা যুমার : ৬৫)
পবিত্র কোরআনে আরো অনেক আয়াতে শিরকের ভয়াবত সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেমন : (সূরা বাকারা : ২২; সূরা নিসা : ১১৬; সূরা মায়েদা: ৭২; সূরা আন’আম:৮৮)
এ কারণে বান্দার ওপর সর্বপ্রথম অপরিহার্য বিষয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তাওহীদ সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা। নিজের ঈমান, আকিদা ও যাবতীয় আমল শিরক মুক্ত রাখা, যাতে কোন আমল বরবাদ না হয়।
নিম্নে আমাদের বাস্তব জীবনে ও সমাজে প্রচলিত নানা ধরনের শিরক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক :
১. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো গায়েবী ক্ষমতায় বিশ্বাস করা : আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর জগতে উপর কর্তৃত্ব রয়েছে বলে বিশ্বাস করা। যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সম্পর্কে এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, সে অলৌকিক শক্তির অধিকারী এবং অলৌকিকভাবেই কোন ঘটনা সংঘটিত করতে, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য, রোজগার হীনকে রোজগার, সন্তানহীনকে সন্তান দিতে পারে, তাহলে সে মুশরিক বলে গণ্য হবে।
২. যাদু-টোনা, বাণ মারা, বধ করা : আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যদি কারো সাথে কারোর শত্রুতার সৃষ্টি হয় এবং এই দু পক্ষের কোন এক পক্ষ যদি দুর্বল হয়, তবে দুর্বলপক্ষ সাধারণত বিভিন্ন জ্বীন সাধকের মাধ্যমে যাদুর আশ্রয় গ্রহণ করে সবল পক্ষকে বাণ মারে বা বোধ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সবল পক্ষ দূর্বল পক্ষকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য জাদুর আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট তথা জ্বীন, পীর, অলি-আউলিয়া, এমনকি হিন্দুদের দেব-দেবীর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করা, নির্দিষ্ট দিনে লাল বা কালো মোরগ জ্বীন বা ভূতের নামে রোগীর জন্য জবেহ করতে বলা কিংবা মিষ্টি বা ফলমূল গায়রুল্লাহর নামে এমনকি হিন্দুদের মন্দিরে অবস্থিত বিভিন্ন দেব দেবীকেও মানত করা।
৩. রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধাতব পদার্থ নির্মীত আংটি বা বালা পরিধান করা : রাজধানী সহ বিভিন্ন শহরের ফুটপাতে এবং বড় বড় পাইকারি বাজারে এমন কিছু ব্যবসা এর দোকান পাওয়া যায়, যারা ধাতব পদার্থ দ্বারা নির্মিত আংটি ও বালা বিক্রি করে থাকে। অনেক লোকদের টা বাত ব্যাথা নিরাময়ের জন্য, কোনো কিছুতে সফল হওয়ার জন্য, শনি ও মঙ্গল গ্রহের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এসব ধাতব পদার্থ দ্বারা নির্মিত আংটি বা বালা পরিধান করে থাকে। আল্লাহর ইচ্ছার বাহিরে কোন বস্তুই নিজস্ব গুনে কোনো রোগের ক্ষেত্রে উপকারী বা অপকারী হতে পারে না। তাই এ সবগুলোই সমাজে প্রচলিত কিছু শিরক এর অন্তর্ভুক্ত।
৪. জ্বীন বা অপর কোনো রোগের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তাবিজ বেবহার করা : জ্বিনের অশুভ দৃষ্টি এবং বিভিন্ন রোগের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ মুসলিমদের মাঝে তাবিজ বেবহার একটা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ সকল ধরনের তাবিজ বেবহার করা শিরক।
৫. মাযার স্পর্শ করা, শরীর মাসেহ করা বা চুমু খাওয়া, কবরের মাটি বরকতের নিয়তে তাবিজে ভরে তা ব্যাবহার করা বা মালিশ করা। রওযা শরীফ, মাযার বা কবর ইত্যাদির ছবি বরকতের জন্যে রাখা, চুমু খাওয়া, সম্মান করা : বিপদ আপদ, বালা- মুসিবত, থেকে বাঁচার জন্য ঘরবাড়িতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বরকতের জন্য দোকান, অফিস, হোটেলে ছবি রেখে আদবের সাথে দাঁড়িয়ে এগুলো করা।
৬. কবর ধোয়া পানি : মাযার কে মাঝে মাঝে ধুমধামের সাথে গোসল করানো হয়। আর এই কবর ধোঁয়া পানি বোতলে করে নিয়ে যাওয়া এবং নেক মাকসুদ পূরণের নিয়তে পান করা।
৭.মাযারে গীলাফের তাযী’ম : বিভিন্ন পীর, ওলি-আউলিয়া, বুযুর্গানে দ্বীনের মাজারে বা কবরে ওপরে আজকাল গিলাফ পড়ানো হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর এই গীলাফ পরিবর্তন করে আবার নতুন গিলাফ পড়ানো হয়।।পুরনো গিলাফ অতি যন্ত সহকারে সংরক্ষণ করা হয়। অজ্ঞ, অশিক্ষিত মানুষ অনেক ক্ষেত্রে এসব গিলাফে চুমু খায়, গীলাফ ধরে ফরিয়াদ জানায়, আদবের সাথে মাথা নিয়ে দাড়িয়ে থাকে, এ গিলাফের সুতা তাবিজে ভরে গলায় বাঁধে। এমনকি অনেকেই আরো একধাপ এগিয়ে গিলফের কাছেই দোয়া চেয়ে বসে।
৮. ওরশ : অনেকে পীরের দরবারে অমাবস্যা, পূর্ণিমা, পীরের জন্ম বা মৃত্যু তারিখ নির্দিষ্ট করে ওরশ হয়ে থাকে। বিজলী বাতি, গেট, চকমকি কাগজ ইত্যাদি দিয়ে প্যান্ডেল সাজানো হয়। বেপর্দা অবস্থায় নারী পুরুষ একত্রে বসে জিকির করে, কাওয়ালী-সামা শোনে। ভন্ড পীর, ফকিরেরা এ সব ওরশ গুলোতে নসিহ’তের নামে শরিয়াহ বিরোধী আকিদা বিশ্বাস প্রচার করে। ওরশ মূলত : আনন্দ উৎসব ও টাকা উপার্জনের পন্থা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
৯.খাজা বাবার ডেগ : একদল লোক বিশেষ করে যুবকেরা রজব মাসে এলেই পথে ঘাটে, বাজারে যেখানেই সুজুগ পায় সেখানেই একটা ডেগ বা বড়ো হাড়ি বসায়। লালসালু কাপড় বিছিয়ে, বাঁশ দিয়ে ছাউনী দিয়ে, বিজলী বাতী জ্বালিয়ে, চকমকি কাগজ এবং বিভিন্ন ধরণের রং লাগিয়ে ঘর সাজিয়ে তার মধ্যে স্থাপন করে ডেগ। তারা একে বলে ‘খাজা বাবার ডেগ’।
১০. প্রাণীর ছবি, চিত্র, প্রতিকৃতি, মূর্তি, ভাস্কর্য ইত্যাদির হুকুম : কোনো নেতা, লিডার, বা স্মরণীয় বরণীয় ব্যাক্তিবর্গের ছবি, চিত্র, প্রতিকৃতি, মূর্তি ও ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরি করা, মাঠে-ঘাটে, অফিস-আদালতে ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এগুলো স্থাপন করা, এগুলোকে সম্মান জানানো, এগুলোর উদ্দেশ্য পুষ্প স্তবক অর্পণ করা ইত্যাদি।
১১.সমাধি, স্মৃতস্তম্ভ ও শহীদ মিনার : সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের স্মরণে সমাধি, স্মৃতস্তম্ভ, স্মৃতিসৌদ বা শহীদ মিনার নির্মাণ, এগুলোকে সম্মান জানানো, সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা ইত্যাদি।
১২. অগ্নিপূজা এবং শিখা চিরন্তন, শিখা অনির্বাণ : ‘অগ্নি শিখা’ অগ্নিপূজকদের উপাস্য দেবতা। তারা ভক্তি, প্রণাম ও নানা কর্মকাণ্ডের দ্বারা আগুনের পূজা করে থাকে। এ অগ্নিপূজা সম্পূর্ণ শিরক ও আল্লাহদ্রোহী কাজ। ‘শিখা চিরন্তন’ বা ‘শিখা অনিবার্ণের’ নামে অগ্নি মশালকে সারাদেশে ঘুরিয়ে ভক্তি, শ্রদ্ধা জানানো এবং এগুলোর প্রজ্জ্বলন কে অব্যাহত রাখার জন্য বিশেষ ধরনের বেদীর ওপর এগুলোর স্থাপন করা, অলিম্পিক মশালসহ বিভিন্ন ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মশাল প্রজ্বলনও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
কিয়ামতের আলামত সমূহ জানতে এখানে ক্লিক করুন:
১৩. মঙ্গল প্রদীপ : হিন্দুদের অনুকরণে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে বা কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন উপলক্ষে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা পালন করা।
১৪. তাসাউফের শায়খ বা পীরের কল্পনা : তাসাউফের শায়খ বা পীরের চেহারা, আকৃতি ইত্যাদি কল্পনা করে মোরাকাবা, ধ্যান, জিকির বা অন্য যেকোনো ইবাদত করা শিরক।
১৫. পীরকে দূর হ’তে ডাকা : অনেকে স্বীয় পীর বা কোন বুজুর্গ ব্যক্তিকে বহুদূর হতে ডাকে এবং মনে করে যে, তিনি এটা জানতেও শুনতে পারছেন। অনেক সময় ‘ইয়া গাউসুল আজম’, ‘ইয়া খাজা মইনুদ্দিন চিশতী’ ইত্যাদি বলে ডাকতে থাকে এবং নিজেদের ফরিয়াদ পেশ করতে থাকে, যা শিরক এর অন্তর্ভুক্ত।
১৬. পীরের জন্য ঘর সাজিয়ে রাখা : কিছু সংখ্যক পীরের অনুসারীরা তাদের বাড়ির মধ্যে একটি ঘর পীরের জন্য সারা বছর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। একটা বড় খাটের উপর চাদর বিছিয়ে বড় বড় কয়েকটা কোল বালিশ সেট করে ‘বিশেষ আসন’ তৈরি করা হয়। পীরের ছবিকে মালা পরিয়ে সযত্নে ওই ঘরে টাঙিয়ে রাখা হয়। ফুল ও জরি দিয়ে ঘরটি সুন্দর করে সাজানো হয়। সারা বছর ওই ঘরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না মাঝে মাঝে মুরিদরা ওই ঘরে ঢুকে ছবি ও আসনের সামনে আদবের সাথে চুপ করে বসে থাকে।
১৭. পীরের বাড়ির বা আস্থানার খাদেম, গরু, কুকুর, বিড়াল, মাছ ও কচ্ছপ ইত্যাদির প্রতি অন্ধ সম্মান : অনেককে দেখা যায়, পীরের বা মাজারের খাদেম, গরু, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি কে দেখামাত্র দাঁড়িয়ে যায়। এগুলোর সামনে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকে আবার এসব গরু, কুকুর, বিড়ালের পা ধরে বসে থাকে, নেক মাকসুদ পূরণের জন্য।
১৮. পীর, ওলি-আওলিয়াদের কবরের মাটি ও সেখানে জ্বালানো মোম বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী মনে করা : এ ধরনের কর্ম আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অহরহ পরিলক্ষিত হয়। তারা বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে আউলিয়াদের কবরের মাটি ও সেখানে জ্বালানো মোমবাতি অনেক উপকারী মহা ঔষধ মনে করে অত্যন্ত যত্নের সাথে তা ব্যবহার করে থাকে এবং এর দ্বারা কোন রোগ মুক্তি হলে তা কবরস্থান ব্যক্তির দান বা তার ফয়েয বলে মনে করে।
১৯. গায়রুল্লাহর নামে জিকির বা অযীফা : আল্লাহর জিকিরের ন্যায় কোন নবী বা রাসূল, পীর, অলি-আউলিয়া, বুজুর্গ, আলিমের নাম জপ করা, বিপদে পড়লে তাদের নামের অযীফা পড়া। যেমন, “ইয়া রাহমাতাল্লিল আলামিন”, “ ইয়া রাসুলাল্লাহ”, ‘হক বাবা’, ‘হক বাবা’ ইত্যাদি।
২০. কামেল পীরের গোনাহ নেই : খোদা পাক, কামেল পীরও পাক। তাদের কোন গোনাহ নেই। তারা নিষ্পাপ। এ ধরনের কথা বলা ও বিশ্বাস করা।
২১. পীরের পায়ে সিজদা করা বা কদমবুসি করা : সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্য পীরের পায়ে সেজদা করা বা নেক মাকছুদ পূরণের জন্য, রোগ মুক্তি নিয়তে পীরের পা চাটা, পায়ে চুমু খাওয়া, গাড়ি চাটা, দাড়িতে চুমু খাওয়া, ব্যবহার থালা বাটি বা অন্য কোন বস্তু চাটা বা চুমু খাওয়া ও মাজারে চুমু খাওয়া।
২২. আল্লাহর সত্তার সাথে মিশে যাওয়া : অনেকের ধারণা মুরিদ যখন “ফানাফিল্লা” পর্যায়ে পৌঁছে তখন সে আল্লাহর সত্তার সাথে মিশে বিলীন হয়ে যায়। (নাউজুবিল্লাহ) এবং তার পৃথক কোন অস্তিত্ব থাকে না। খাওয়া, ঘুম, স্ত্রী সহবাস সহ যাবতীয় কাজকর্ম তখন আর নিজস্ব থাকে না। এগুলো সব আল্লাহর হয়ে যায় অর্থাৎ এসব কাজ আল্লাহ নিজেই করেন। (নাউজুবিল্লাহ)
২৩. আল্লাহ্ যা করান, তাই করি : একদল ফকীর বলে, আল্লাহ যা করান, তাই করি। আল্লাহ সালাত আদায় করার না, তাই আদায় করি না। আল্লাহ গাঁজা টানাচ্ছেন, তাই টানি। তাকদীরে সালাত থাকলে তো আদায় করব।
২৪. দিলে দিলে সালাত পড়ি : অনেক পীর নামাজ, রোজার ধার ধারে না; কিন্তু খুব সাধনা করে! দু’তিন দিন পর পর একটু খায়। কম কথা বলে। লোকজনের সাথে কম মিশে। দিনের বেশিরভাগ সময় চুপ করে ধ্যানে মগ্ন অবস্থায় বসে থাকে। এরা বলে, আমরা দিলে দিলে সালাত পরি। তোমরা মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত পড়ো আর আমরা সারা দিন-রাতেই সালাত পড়ি।
২৫. সিনায় সিনায় মা’রেফতী : পীর বা দরবেশ দাবিদার একদল লোক বলে থাকে, ‘কোরআন শরীফ মোট ৪০ পারা।’ ৩০ পারা পারায় যাহেরি ইলমের বিষয় আছে। বাকি ১০ পারা মারেফতি বিদ্যায় ভরা রয়েছে। এ ১০ পারা আমরা সিনায় সিনায় পেয়েছি। শরীয়তের আলেমরা এগুলোর খবর রাখে না।
২৬. শরীয়াতের ইত্তেবা সর্বাবস্থায় ফরজ নয় : অনেকের ধারণা, মুরিদ যখন মা’রেফাতের উচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়, তখন তার জন্য শরীয়াতের হুকুম আহকাম, সালাত, সওম ইত্যাদি মাফ হয়ে যায়।
২৭. শিরকের গন্ধযুক্ত নাম বা সম্মোধন : যে সকল নাম বা সম্বোধনে শিরকের সংস্পর্শ পাওয়া যায় সেগুলোকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। জাহিলি যুগে মানুষ নিজের সন্তান-সন্তানাদি নাম সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদির নামের সাথে সম্পৃক্ত করে রাখত। যেমন- আবদে শামস বা সূর্যের গোলাম, আবদে মানাফ বা মানাফের গোলাম ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এই ধরনের নাম রাখতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন।
২৮. শিরকের গন্ধযুক্ত উপাধি : পীর বা ওলিকে এমন কোন উপাধিতে সম্বোধন করা উচিত নয় যা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহ তা’আলার জন্য প্রযোজ্য। যেমন- ‘গাউসুল আজম’ (সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী), গরীবে নেওয়াজ (গরীবরা যার মুখাপেক্ষী), মুশকিল কোশা (যার মাধ্যমে বিপদ দুর হয়), কাইয়ুমে যামান (যামানা কায়েম করেছেন যিনি) ইত্যাদি।
২৯. সন্তানের নামকরণে নবী ও পীর আওলিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন : গোলাম মোস্তফা (মুস্তফার গোলাম), আবদুন্নবি (নবীর দাস), আব্দুর রাসুল, আলি বখশ (আলী আ: এর দান), হোসেন বখশ (হোসেনের দান), পীর বখশ (পীরের দান), মাদার বখশ (মাদারের দান), গোলাম মহিউদ্দিন (পীর মহিউদ্দিনের গোলাম), আব্দুল হাসান (হাসানের গোলাম), আব্দুল হোসাইন (হোসাইনের গোলাম), গোলাম রাসূল (রাসূলের গোলাম ) গোলাম সাকলায়েন ইত্যাদি নাম রাখা।
৩০. বিপদে পড়লে জ্বীন, ফেরেস্তা, পীর, অলি-আওলিয়াদের ডাকা : দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ, মূর্খ, পীর ও মাজার পূজারী অনেক লোককে দেখা যায় বিপদে-আপদে, রোগে-শোকে আল্লাহ তা’য়ালাকে বাদ দিয়ে পীর, ওলী, জিন ও ফেরেশতাদেরকে আহবান করতে থাকে। যেমন- ‘ইয়া গাউসুল আজম বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী’, ‘ইয়া খাজা বাবা’, ‘ইয়া সুলতানুল আউলিয়া’, ‘হে পীর কিবলাজান’, হে জ্বীন… আমাকে রক্ষা করুন, আমাকে বিপদ হতে বাঁচান, আমার মাকসুদ পূরণ করুন, সন্তান দিন ইত্যাদি। কোন কোন মূর্খ লোক বালা মুসিবতের সময় বুজুর্গ লোকদের উদ্দেশ্যে দোয়া করে ফরিয়াদ জানায়। এভাবে গাইরুল্লাহকে ডাকা এবং তাদের কাছে নিজের ফরিয়াদ পেশ করা, তা কাছ থেকে হোক আর দূর থেকেই হোক।
৩১. মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তন : সিলভা, কোয়ান্টাম বা অন্য কোন মেথডের (পদ্ধতি) দ্বারা মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো এবং সকল সমস্যার সমাধান লাভ করার মাধ্যমে জীবনের সফলতা অর্জন করার কথা বলা।
৩২. কপালে টাকা স্পর্শ করে তা সম্মান করা : টাকা পয়সা মানুষের সম্পদ তা মানুষের জীবনে প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে টাকা পয়সা মানুষের খাদিম। কিন্তু মানুষ টাকার খাদিম বা গোলাম নয়। সম্পদের সম্মান হচ্ছে তাকে সংরক্ষণ করা তাকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ জ্ঞান না করা পায়ের নিচে ফেলে এটাকে দলিত-মলিত না করা। মাথা ও কপাল ঠেকিয়ে আল্লাহর ইবাদত করা হয় এবং তাকে সম্মান জানানো হয়। তাই কপালে টাকা স্পর্শ করে টাকা কে সম্মান করা বা ‘Money is the Second God’ 💰 বলা টাকাকে পূজা করাই সামিল। এ কাজটি অনেক মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। দোকান খোলার পর প্রথম বিক্রি হলে তারা এই কাজটি করে থাকে।
৩৩. গ্রহ নক্ষত্রের তা’ছির (প্রভাব) : অনেকের ধারণা মানুষের ভালো-মন্দ, বিপদ-আপদ, উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে হয়। কেউ বিপদে পড়লে বলা হয় এ ব্যক্তির ওপর শনি গ্রহের প্রভাব পড়েছে।কারো আনন্দের খবর শুনলে বলা হয় থাকে, এই ব্যক্তির মঙ্গল গ্রহের নজরে সু নজরে আছে।
৩৪. চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের প্রভাব : অনেকের ধারণা চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ মানুষের ভালো-মন্দ, জন্ম-মৃত্যু, বিপদ-আপদ এর উপর প্রভাব বিস্তার করে।
৩৫. কোন মাস বা সময়কে ভালো বা খারাপ জানা : আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ সময় ও দিনক্ষণের ভালো মন্দে বিশ্বাসী। মহরম, কার্তিক প্রভৃতি মাসে বিয়ে-সাথি করা উচিত নয়, রবি ও বৃহস্পতিবারে বাঁশ কাটা যায় ন, সোম ও বুধবারে গোলা হতে ধান বের করা যায় না, শুক্র ও রবিবারে পশ্চিম দিকে যাত্রা করলে ক্ষতি হবে।
শনি ও মঙ্গলবারে বিয়ে করা ও ঝাড়ু বাধা উচিত নয়, রাতের বেলায় ঝাড়ু দিলে আয় উন্নতি হয় না, রাতে আয়না দেখলে কঠিন পীড়া হয়, রাতে নখ কাটা যায় না, নতুন বউকে ভাদ্র মাসে শশুর বাড়িতে রাখা হয় না, (কারণ নতুন বছরে পা ভাদ্র মাসে শশুর শাশুড়ির জন্য দেখা অকল্যাণকর), ভাদ্র ও পৌষ মাসে মেয়ে লোকদের সওয়ারি পাঠানো যায় না, আশ্বিন মাস যাবার দিন মুটে বানিয়ে গরুকে গা ধৌত করা ও ‘গো ফাল্গুন’ বলে মান্য করা ইত্যাদি।
৩৬. নবজাতকের জন্য : নবজাতকের হাতের চামড়ার চিকন তার বা তাগা বা গাছ বা এ ধরনের অন্য কোন কিছু চুরির মত করে বেঁধে দেওয়া হয় যাতে কোন অশুভ রোগ-বালাই বা বদ জ্বীন-ভূত স্পর্শ করতে না পারে। আবার নবজাত শিশুকে জিনের অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য বাচ্চার কান ছিদ্র করা, বাচ্চার বালিশের নিচে জুতার টুকরা রাখা অথবা শিশুর মাথার চুল না কাটা। চোখ লাগা থেকে শিশুসন্তানকে রক্ষার জন্য সন্তানের গলায় মাছের হাড়, শামুক ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখা। কপালে কালো টিপ বা দাগ দেওয়া।
৩৭. গায়রুল্লাহর নামে কসম করা : আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেন, যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর নামে কসম করলো, সে কুফুরি করলো অথবা শিরক করলো। [4] মূলত আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন নামে কসম করলে কসম হয় না। যেমন- রাসূলুল্লাহর কসম, কাবা শরীফের কসম, নিজ চোখের কসম, বিদ্যা বা বইয়ের কসম ইত্যাদি।
৩৮. আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পীর, ওলী বা বুজুর্গ ব্যক্তির উসিলা গ্রহণ : আল্লাহকে পাওয়ার জন্য তার নৈকট্য ও লাভের লক্ষ্যে ক্ষমা ও সাহায্য পাওয়ার আমার কোন জীবিত বা মৃত পীর, অলি বা।বুজুর্গ ব্যক্তি কে ওসিলা বা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা।
৩৯. জ্যোতিবিদ্যা সংক্রান্ত : জ্যোতিবিদ্যা হলো সৌরজগতের বিভিন্ন অবস্থা পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কারণ বর্ণনা করা। জ্যোতিবিদরা বলে থাকেন যে অমুক নক্ষত্রের অমুক স্থানে অবস্থানের সময়ে যে ব্যক্তি বিবাহ করবে তার অমুক অমুক জিনিস অর্জিত হবে।
যে ব্যক্তি অমুক নক্ষত্রের অমুক জায়গায় অবস্থানের ক্ষণে সফরে থাকবে সে ভাগ্যবান কিংবা ভাগ্যহীন হবে। যেমন- বর্তমানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ ধরনের অর্থহীন খবরাখবর পরিবেশন করা হয়, আর এগুলোর আশেপাশে বিক্ষিপ্ত তারকারাজি, সরলরেখা, বক্ররেখা ইত্যাদি ধরনের আঁকাবাঁকা রেখা অঙ্কিত থাকে। কিছু সংখ্যক মূর্খ ও দুর্বল ঈমানের মানুষও বিভিন্ন সময় জ্যোতিষীদের নিকট গমন করে থাকে এবং তাদেরকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, বিবাহ-সাদি ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করে থাকে।
৪০. কোন ব্যক্তি তৈরীর মতবাদকে বা কোন ব্যক্তির চিন্তা ধারাকে আল্লাহর প্রদত্ত বিধান ও ধ্যান-ধারণার চেয়ে উত্তম মনে করে, জীবন ধারণ করা শিরক। যেমন- কেউ যদি কাল মার্কসের আদর্শকে আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালার দেয়া বিধানের চেয়ে উত্তম মনে করে, এবং সে আদর্শ বাস্তবায়ন করে, তবে তা শিরক।
-হাজ্জাজ বিন ইউসুফ