যাদের উপর যাকাত ফরজ
জাকাত কি ?
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেন। তখন সে রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা চালু হয়। বৈধ উপার্জন থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করা নাম হচ্ছে যাকাত।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যে শস্য উৎপন্ন করি, তা থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় (জাকাত দাও) কর। (সুরা বাকারা : ২৬৭)
ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হচ্ছে : নামাজ ও যাকাত। কোরআনে কারীমে বহু স্থানে নামাজ ও যাকাতের আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সওয়াব রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যাকাত অস্বীকারকারী নিঃসন্দেহে কাফের।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা নামাজ আদায় করো এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিয়ে নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহ নিকট পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখছেন। (সূরা বাকারা : ১১০)
অন্য আয়াতে এরশাদ করেন- “তোমরা নামাজ আদায় করো যাকাত দাও এবং রাসুলের আনুগত্য করো যাতে তোমরা অনুগ্রহ ভাজন হতে পারো।” (সূরা নূর : ৫৬)
যাকাতের গুরুত্ব
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। যাকাত দিলে সম্পদ কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। এটি আপনার উপার্জিত ও জমা রাখা সম্পদকে পবিত্র করে। যাকাত আদায়কারীর পুরস্কার হচ্ছে; আল্লাহর সন্তুষ্টি, আখেরাতের মুক্তি ও জান্নাত।
যাকাত আদায়কারীর জন্য যাকাত দেওয়াকে দয়া দাক্ষিণ্য হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যাকাত আদায় করা দয়া নয় বরং গরিবের হক। ইসলামী শরীয়াহ মতে সুষ্ঠুভাবে যাকাত বন্টন করা গেলে দারিদ্র্যমুক্ত একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। যাকাত ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনে। কিন্তু আফসোস হচ্ছে আমাদের সমাজের অনেক মুসলমান আছেন যাদের সম্পদ আছে, নামাজ পড়েন রোজাও রাখেন কিন্তু যাকাত আদায় করেন না।
সম্পদ জমা করে রাখার বিধান
মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “যারা সোনা ও রুপা পুঞ্জিভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে ছ্যাক দেওয়া হবে। আর বলা হবে এটা তা-ই যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে; সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ করো। (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫)
হাদিসে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন কিন্তু তিনি যাকাত আদায় করেননি, কেয়ামতের দিন তার সম্পর্কে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুপাশে কামড়ে ধরে বলবে- আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল।
যাদের উপর যাকাত ফরজ
যাদের উপর যাকাত ফরজ তা বর্ননা করা হলো- ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী এমন প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর উপর যাকাত আদায় করা ফরজ যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যায়। ১.মুসলিম হওয়া। ২.স্বাধীন হওয়া। ৩.আকেল হওয়া। ৪.বালেক হওয়া। ৫.নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা। ৬.পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকা। ৭.সম্পদের মালিকানা পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া।
যাদের উপর যাকাত ফরজ নয়
যাদের উপর যাকাত ফরজ নয় তা হচ্ছে- কোন অমুসলিম কাফের এর উপর যাকাত ফরজ নয়। কেননা তারা ইবাদতের যোগ্যতা রাখে না। তাই তাদের ওপর যাকাত আসে না। এছাড়া অসুস্থ মস্তিষ্ক মুসলিমের ওপর এবং নাবালেক শিশু কিশোরের ওপর যাকাত ফরজ নয়।
যেসব জিনিসের উপর যাকাত ফরজ হয়
১. সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর উপর যাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্য যাকাত ফরজ হয়।
২. সোনা রুপার অলংকার সর্বদা ব্যবহার হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার করা না হোক; সর্বাবস্থাতেই তার যাকাত দিতে হবে। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২৫৫)
৩. অলংকার ছাড়া সোনা রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপর ও যাকাত ফরজ হয়। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ৭০৬১)
৪. জামা কাপড় কিংবা অন্য কোন সামগ্রীতে সোনা রুপার কারুকাজ করা থাকলে তা-ও যাকাতের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং যে পরিমাণ সোনা-রুপা কারুকাজে লেগেছে; অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গেও তারও যাকাত দিতে হবে।
৫. সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোন ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসাপণ্য না হলে সেগুলোতে যাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ৬/৪৪৭-৪৪৮)
৬. মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা নেসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে; বছর শেষে তা যাকাত আদায় করা ফরজ। তদ্রূপ ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতই। এসবের ওপরও যাকাত ফরজ হয়।
৭. টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনকি রেখে দিলেও তাতে যাকাত ফরজ হয়।
৮. হজ্জের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘর বাড়ি নির্মাণ, ছেলেমেয়ে বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য; যে অর্থ সঞ্চয় করা হচ্ছে তাও এর ব্যতিক্রম নয়। সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিসাব পরিমান হলে এবং হিসাবের ওপর এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত ফরজ হবে। বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তা যদি খরচ হয়ে যায় তাহলে যাকাত ফরজ হবে না। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ৭০৩২)
৯. দোকান-পাটে যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা থাকে তা বাণিজ্যিক-দ্রব্য। এর মূল্য নেসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮)
১০. ব্যবসার নিয়তে কোন কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক। যেমন- জমি-জামা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর যেমন- মুদী সামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অলংকার, নির্মাণ সামগ্রী, ফার্নিচার, ইলেকট্রিক সামগ্রী, হার্ডওয়ার সামগ্রী, বই পুস্তক ইত্যাদি তা বাণিজ্য-দ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দেওয়া ফরজ হবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ৭১০৩)
আরো পড়ুন :
রমজানের রোজা কত হিজরীতে ফরজ হয়েছে ?
ট্যাগ সমূহ : যাদের উপর যাকাত ফরজ,যেসব জিনিসের উপর যাকাত ফরজ হয়,যাদের উপর যাকাত ফরজ নয়,যাদের উপর যাকাত ফরজ,যাকাতের গুরুত্ব,জাকাত কি,সম্পদ জমা করে রাখার বিধান |