রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ :

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম ”রোজা”। ঈমান, নামাজ ও যাকাতের পরেই রোজার স্থান।

আরবি ভাষায় রোজা কে ‘সাওম’ বলা হয়। যার আভিধানিক অর্থ : বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় সাওম বলা হয়, ‘সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজা ভঙ্গকারী কাজ থেকে বিরত থাকাকে’।

আল্লাহ তা’য়ালা পরিপূর্ণ হেকমত অনুযায়ী রোজার বিধান জারি করেছেন। তিনি রোজাদারকে ভারসাম্য রক্ষা করে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। একদিকে যাতে রোজা রাখার কারণে রোজাদারের শারীরিক কোন ক্ষতি না হয়; আর অন্যদিকে সে যেন রোজা বিনষ্টকারী কোন বিষয়ে লিপ্ত না হয়। এই কারণে রোজা বিনষ্টকারী বিষয়গুলো দুই ভাগে বিভক্ত :

১.কিছু রোজা ভঙ্গের কারণ বা বিষয় রয়েছে যেগুলো শরীর থেকে কোনো কিছু নির্গত হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, সহবাস করা, হায়েজ ও শিঙ্গা লাগানো। শরীর থেকে এসব নির্গত হওয়ার কারণে শরীর দুর্বল হয়। এ কারণেই আল্লাহ তা’য়ালা এগুলোকে রোজা ভঙ্গকারী বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। যাতে করে এগুলো নির্গত হওয়ার দুর্বলতা ও রোজা রাখার দুর্বলতা উপায়টি একত্রিত না হয়। এমনটি ঘটলে রোজার মাধ্যমে রোজাদার ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং রোজা বা উপবাসের ক্ষেত্রে আর ভারসাম্য বজায় থাকবে না।

২. আর কিছু রোজা ভঙ্গের কারণ বা বিষয়ে আছে যেগুলো শরীরে প্রবেশ করানোর সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, পানাহার। তাই রোজাদার যদি পানাহার করে, তাহলে যে উদ্দেশ্যে রোজার বিধান জারি করা হয়েছে; সেটা বাস্তবায়িত হবে না।

আল্লাহ তা’য়ালা রোজা বিনষ্টকারী বিষয়গুলোর মূলনীতি উল্লেখ করেছেন তিনি বলেন,

“এখন তোমরা নিজ স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু লিখে রেখেছেন তা (সন্তান) তালাশ করো। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কালো সুতা থেকে ভোরের শুভ্র সুতা পরিষ্কার ফুটে ওঠে। (সূরা বাকারা; আয়াত : ১৮৭)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা রোজা ভঙ্গের কারণ এর প্রধান বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে- পানহার ও সহবাস করা। আর রোজা নষ্টকারী অন্য বিষয়গুলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাদিসে উল্লেখ করেছেন।

আজ আমরা এমন কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জেনে নেব- যেসব কাজে কারণে রোজা বাতিল হয়ে যায়।

রোজা ভঙ্গের কারণ ৭ টি সেগুলো হচ্ছে,

১. সহবাস করা।

২. হস্তমৈথুন করা।

৩. পানাহার।

৪. যা কিছু পানাহারের স্থানাভিষিক্ত।

৫. শিঙ্গা লাগানো কিংবা এই জাতীয় অন্য কোন কারণে রক্ত বের করা।

৬. ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা।

৭. মহিলাদের হায়েজ ও নিফাসের রক্ত বের হওয়া।

রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ বিস্তারিত বর্ননা :

১.সহবাস করা : রোজা ভঙ্গের কারণ এর অন্যতম কারন হচ্ছে স্ত্রী সহবাস করা। রোজা ভঙ্গের কারণ গুলোর মধ্যে প্রধান ও প্রথম হচ্ছে সহবাস করা। এটি সবচাইতে বড় রোজা নষ্টকারী বিষয় ও এতে সবচাইতে বেশি গুনাহ হয়। যে ব্যক্তি দিনের বেলায় সেচ্ছায় স্ত্রী সহবাস করবে তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে; বীর্যপাত হোক কিংবা না হোক। তার উপর তওবা করা, সেদিনের রোজা পূর্ণ করা , পরবর্তীতে এই দিনের রোজা কাজা করা ও কঠিন কাফফারা আদায় করা ফরজ। এর দলীল হচ্ছে;

আবু হুরায়রা রাঃ কর্তৃক বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ) এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি ধ্বংস হয়েছি। নবী করীম (সা:) বললেন কিসে তোমাকে ধ্বংস করল ? সে বললো আমি রমজানের দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করে ফেলেছি। তিনি বললেন, তুমি কি একটি ক্রীতদাস আজাদ করতে পারবে ? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহলে লাগাতার দু’মাস রোজা রাখতে পারবে ? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহলে ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়াতে পারবে ? সে বলল, না। (বুখারী : ১৯৩৬) ও (মুসলিম : ১১১১)

স্ত্রী সহবাস ছাড়া অন্য কোনো কারণে কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব হয় না।

২. হস্তমৈথূন : রোজা ভঙ্গের কারণ এর অন্যতম কারন হচ্ছে হস্তমৈথুন। হস্তমৈথুন বলতে বুঝায় হাত দিয়ে কিংবা অন্য কিছু দিয়ে বীর্যপাত ঘটানো। এটি করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। এর দলীল হচ্ছে: হাদীসে কুদসীতে রোযাদার সম্পর্কে আল্লাহর বাণী : “সে আমার কারণে পানাহার ও যৌনকর্ম পরিহার করে” সুতরাং যে ব্যাক্তি রমজানের দিনের বেলায় হস্তমৈথুন করবে তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। তখন তার উপর ফরজ হচ্ছে – তওবা করা, সে দিনের বাকি সময় উপবাস থাকা এবং পরবর্তীতে সেই রোজাটির কাযা পালন করা। আর যদি এমন হয় যে, হস্তমৈথুন শুরু করেছে কিন্তু বীর্যপাতের আগেই স্থগিত করছে তাহলে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে; তার রোজা সহিহ্। বীর্যপাত যা করার কারণে তার এই রোজা টি আর কাজা করতে হবে না।

রোজাদারের উচিত হচ্ছে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সব কিছু থেকে বিরত থাকা এবং সব কুচিন্তা থেকে নিজের মনকে প্রতিহত করা। আর যদি মজি বের হয়, তাহেল অগ্রগণ্য মতানুযায়ী এটি রোজা ভঙ্গকারী নয়।

৩. পানাহার : পানাহার বলতে বোঝাবে মুখ দিয়ে কোন কিছু পাকস্থলীতে পৌঁছানো। অনুরূপভাবে নাক দিয়ে কোন কিছু যদি পাকস্থলীতে পৌঁছানো হয় সেটাও পানাহারের পর্যায়ভুক্ত। এ কারণে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তুমি ভালো করে নাকে পানি দাও; যদি না তুমি রোজাদার হও।” (সুনানে তিরমিজি ৭৮৮) নাক দিয়ে পাকস্থলীতে পানি প্রবেশ করানো যদি রোজাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করতো, তাহলে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভালো করে নাকে পানি দিতে নিষেধ করতেন না।

৪. যা কিছু পানাহারের স্থানাভিষিক্ত : এটি দুইটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে।

(ক). যদি রোজাদারের শরীরে রক্ত পুশ করা হয়। যেমন, আহত হয়ে রক্তক্ষরণের কারণে কারো শরীরে যদি রক্ত পুশ করা হয়, তাহলে সে ব্যক্তির রোজা ভেঙ্গে যাবে। যেহেতু পানাহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে- রক্ত তৈরি।

(খ). খাদ্যর বিকল্প হিসাবে ইনজেকশন পুশ করা। কারণ, এমন ইঞ্জেকশন নিলে পানাহারের প্রয়োজন হয় না। তবে যেসব ইঞ্জেকশন পানাহারের স্থানাভিষিক্ত নয়; বরং চিকিৎসার জন্য দেওয়া হয়। যেমন- ইনসুলিন, পেনিসিলিন কিংবা শরীর চাঙ্গা করার জন্য যেসব দেওয়া হয় কিংবা টিকা হিসাবে দেওয়া হয় এগুলোর জন্য রোজা ভঙ্গ হবে না। চাই এসব ইনজেকশন মাংসপেশিতে দেওয়া হোক কিংবা শিরাতে দেওয়া হোক। তবে সাবধানতা স্বরুপ এসব ইনজেকশন হাতে নেওয়া যেতে পারে।

৫. শিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে রক্ত বের করা : সিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে রক্ত বের করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। দলিল হচ্ছে : নবী করীম (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি সিঙ্গা লাগায় ও যার শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ে রোজা ভেঙে যাবে। [সুনানে আবু দাউদ (২৩৬৭) ও আলবানী সহিহ্ আবু দাউদ গ্রন্থে (২০৪৭) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।]

৬. ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা : রোজা ভঙ্গের কারণ এর অন্যতম কারন হচ্ছে : “যে ব্যক্তির অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি এসে যায়, তাকে উক্ত রোজা কাজা করতে হবে না। কিন্তু, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বমি করল; তাকে সে রোজা কাজা করতে হবে। [সুনানে তিরমিজি (৭২০) ও আলবানী সহিহ্ তিরমিজি গ্রন্থে (৫৭৭) হাদিস টিকে সহিহ্ বলেছে।]

৭. হায়েজ ও নিফাসের রক্ত নির্গত হওয়া : রোজা ভঙ্গের কারণ এর অন্যতম হায়েজ ও নিফাসের রক্ত নির্গত হওয়া। নবি করিম (সা:) বলেছেন, “যখন মহিলাদের হায়েজ হয় তখন কি তারা নামাজ ও রোজা ত্যাগ করে না ?” (বুখারী : ৩০৪) তাই কোনো নারীর হায়েজ কিংবা নিফাসের রক্ত নির্গত হওয়া শুরু হলে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এমনকি সেটা সূর্যাস্তের সামান্য কিছু সময় পূর্বে হলেও। আর কোনো নারী যদি অনুভব করে যে, তার হায়েজ শুরু হতে যাচ্ছে; কিন্তু সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত রক্ত বের হয়নি তাহলে তার রোজা শুদ্ধ হবে এবং সেদিনের রোজা তাকে কাযা করতে হবে না।

আর যদি হায়েজ ও নিফাসগ্রস্ত নারীর রক্ত রাত থাকতেই বন্ধ হয়ে যায় এবং সাথে সাথেই তিনি রোজার নিয়ত করে নেন; তবে গোসল করার আগেই ফরজ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে আলেমদের মাজহাব হচ্ছে; তার রোজা শুদ্ধ হবে

আরো পড়ুন :

রোজার ফরজ কয়টি ও কি কি ?

নামাজের ওয়াজিব ১৪ টি

নামাজের ফরজ মোট 13 টি

১১৪. সূরা নাস এর তাফীসর

০১. সূরা ফাতিহা এর তাফসীর নামকরন ও শানে-নুযূল

সমাজে প্রচলিত কিছু বিদআত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top