কুরবানির ইতিহাস ও ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী

কুরবানির ইতিহাস ও সর্বপ্রথম কুরবানী

কুরবানির ইতিহাস
কুরবানীর ইতিহাস ততোটা প্রাচীন যতোটা প্রাচীন ধর্ম অথবা মানবের ইতিহাস। মানুষ বিভিন্ন যুগে সমান শ্রদ্ধা, জীবনদান, আত্মসমর্পণ, প্রেম- ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, ত্যাগ ও কুরবানী, পূজা-অর্চনা ও আনুগত্য প্রভৃতির যে যে পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, আল্লাহর শরীয়াত মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং আবেগ অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রেখে ওসব পন্থা-পদ্ধতি স্বীয় বিশিষ্ট নৈতিক সংস্কার সংশোধনসহ আল্লাহ তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মানুষ তাদের আপন কল্পিত দেব-দেবীর সামনে জীবন দানও করেছে। আর এটাই হচ্ছে কুরবানীর উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। এ জীবন দানকেও আল্লাহ তাঁর নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ ধরনের জীবন উৎসর্গ তিনি ছাড়া অন্যের জন্যে হারাম ঘোষণা করেছেন।

মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানী হযরত আদম (আ)-এর দু’ পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী । এর উল্লেখ কুরআন পাকে রয়েছে,

وَ اتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِهِمَا وَ لَمۡ یُتَقَبَّلۡ من الاخرِ

অর্থ“: এবং তাদেরকে আদমের দু’ পুত্রের কাহিনী ঠিকমতো শুনিয়ে দাও। যখন তারা দু’জনে কুরবানী করলো, একজনের কুরবানী কবুল হলো, অপরজনের হলো না।”-(সূরা আল মায়েদা : ২৭)

প্রকৃতপক্ষে একজন, যার নাম ছিল হাবিল, মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে একটি অতি সুন্দর দুম্বা কুরবানীরূপে পেশ করে। অপর ব্যক্তির নাম ছিল কাবিল। সে অমনোযোগ সহকারে খাদ্যের অনুপযোগী খানিক পরিমাণ খাদ্য শস্য কুরবানী স্বরূপ পেশ করলো । হাবিলের কুরবানী আকাশ থেকে এক খণ্ড আগুন এসে জ্বালিয়ে গেল। এটাকে কবুল হওয়ার আলামত মনে করা হতো। অপরদিকে কাবিলের খাদ্য শস্য আগুন স্পর্শই করলো না। আর তা ছিল কবুল না হওয়ার আলামত।

কুরবানী এক বিরাট স্মরণীয় বস্তু
আজকাল দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমানরা যে কুরবানী করে এবং তার ফলে বিরাট উৎসর্গের যে দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে হযরত ইসমাঈল (আ) এর ফিদিয়া। কুরআনে এ মহান কুরবানীর ঘটনা পেশ করে তাকে ইস লাম, ঈমান ও ইহসান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কুরবানী প্রকৃতপক্ষে এমন এক সংকল্প, দৃঢ় বিশ্বাস, আত্মসমর্পণ ও জীবন দেয়ার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মানুষের কাছে যাকিছু আছে তা সবই আল্লাহর এবং তাঁর পথেই তা উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত। এটা এ সত্যেরও নিদর্শন যে, আল্লাহর ইংগিত হলেই বান্দাহ তাঁর রক্ত দিতেও দ্বিধা করে না। এ শপথ, আত্মসমর্পণ ও জীবন বিলিয়ে দেয়ার নামই ঈমান, ইসলাম ও ইহসান।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “ অতঃপর যখন সে [ইসমাঈল (আ.)] সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল তখন একদিন ইবরাহীম (আ.) তাকে বললো, প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যেন যবেহ করছি। বল দেখি কি করা যায়? পুত্র (বিনা দ্বিধায়) বললো, আব্বা ! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা শীঘ্র করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে অবিচল দেখতে পাবেন।

অবশেষে যখন পিতা পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সপর্দ করলেন এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুর করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে), তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, ইবরাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ । আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট অগ্নি পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কুরবানী ফিদিয়া স্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি। আর আমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে (ইবরাহীমের) এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম। শান্তি ইবরাহীমের ওপর, এভাবে জীবনদানকারীদেরকে আমরা এ ধরনের প্রতিদানই দিয়ে থাকি । নিশ্চিতরূপে সে আমাদের মু’মিন বান্দাদের মধ্যে শামিল।”-(সূরা আস সাফ্ফাত : ১০২-১১১)

অর্থাৎ যতোদিন দুনিয়া টিকে থাকবে, ততোদিন উম্মতে মুসলেমার মধ্যে কুরবানীর এ বিরাট স্মৃতি হযরত ইসমাঈল (আ)-এর ফিদিয়া রূপে অক্ষুণ্ণ থাকবে। আল্লাহ এ ফিদিয়ার বিনিময়ে হযরত ইসমাঈল (আ)-এর জীবন রক্ষা করেন এ উদ্দেশ্যে যে, কিয়ামত পর্যন্ত যেন তাঁর উৎসর্গীকৃত বান্দাগণ ঠিক এ দিনে দুনিয়া জুড়ে কুরবানী করতে পারে। এভাবে যেন তারা আনুগত্য ও জীবন দেয়ার এ মহান ঘটনার স্মৃতি জাগ্রত রাখতে পারে। কুরবানীর এ অপরিবর্তনীয় সুন্নাতের প্রবর্তক হযরত ইবরাহীম (আ) এবং হযরত ইসমাঈল (আ)। আর এ সুন্নাতকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখবে হযরত নবী মুহাম্মদ (স)-এর উম্মতের জীবন দানকারী মু’মিনগণ।

সকল শরীয়াতে কুরবানী
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যতো শরীয়াত নাযিল হয়েছে সে সবের মধ্যে কুরবানীর হুকুম ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ ।

وَ لِکُلِّ اُمَّۃٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَکًا لِّیَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰهِ عَلٰی مَا رَزَقَهم منۡ بهِیمۃِ الاَنعمِ
অর্থ“: “এবং আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্যে কুরবানীর এক রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ঐসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।”-(সূরা হজ্জ আয়াত নং : ৩৪)

অর্থাৎ কুরবানী প্রত্যেক শরীয়াতের ইবাদাতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও জাতির নবীদের শরীয়াতে অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরবানীর নিয়ম-পদ্ধতি ও খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ ভিন্ন ভিন্ন রয়েছে। কিন্তু মৌলিক দিক দিয়ে সকল আসমানী শরীয়াতে একথা যে, পশু কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যেই করতে হবে এবং করতে হবে তাঁর নাম নিয়েই। فاذكروا اسم الله عليها – “অতএব ঐসব পশুর ওপরে শুধু আল্লাহর নাম নাও।”

পশুর ওপর আল্লাহরই নাম নেয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, অর্থাৎ তাকে যবেহ করতে হলে আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ করতে হবে এবং তাঁর নাম নিয়েই তাঁর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে যবেহ কর। কারণ তিনি তোমাদেরকে
এসব পশু দান করেছেন। তিনি এসব তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি তাদের মধ্যে তোমাদের জন্যে বিভিন্ন মংগল নিহিত রেখেছেন।

নবী (স)-এর প্রতি নির্দেশ
কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে নবী করিম (স.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এই যে,
إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العلمين لاشريك له وبذلك أمرت وأنا أول المسلمين – (الانعام : ١٦٢-١٦٣)

অর্থ“: “বলুন, [হে মুহাম্মদ (স.)] আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তাঁর কোনো শরীক নেই, আমাকে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তাঁর অনুগত ও ফরমা বরদার।”-(সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩)

আল্লাহর ওপর পাকা-পোক্ত ঈমান এবং তাঁর তাওহীদের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের অর্থই এই যে, মানুষের সকল চেষ্টা-চরিত্র তাঁরই সন্তুষ্টির জন্যে নির্দিষ্ট হবে। আর সে ঐসব কিছুই তার পথে কুরবান করে তার ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও জীবন দেয়ার প্রমাণ পেশ করবে।

কুরবানীর প্রকৃত স্থান তো সেটা যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হাজী তাদের নিজ নিজ কুরবানী পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে হজ্জের অন্যতম আমল। কিন্তু মেহেরবান আল্লাহ এ বিরাট মর্যাদা থেকে তাদেরকেও বঞ্চিত করেননি যারা মক্কা থেকে দূরে রয়েছে এবং হজ্জে শরীক হয়নি। কুরবানীর আদেশ শুধু তাদের জন্যে নয় যারা বায়তুল্লাহর হজ্জ করে, বরঞ্চ এ এক সাধারণ নির্দেশ। এটা প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমানের জন্যে। আর একথা হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন—নবী (স) দশ বছর মদীনায় বাস করেন এবং প্রতি বছর কুরবানী করতে থাকেন।-(তিরমিযি, মেশকাত) নবী (স.) আরো বলেন, যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে।-(জামউল ফাওয়ায়েদ)

হযরত আনাস (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) ঈদুল আযহার দিনে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে কুরবানি করেছে তাকে পুনরায় করতে হবে। যে নামাজের পরে করেছে তার কুরবানী পূর্ণ হয়েছে এবং সে ঠিক মুসলমানের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। একথা ঠিক যে, ঈদুল আযহার দিনে মক্কায় এমন কোনো নামায হয় না যার আগে কুরবানী করা মুসলমানদের সুন্নাতের খেলাপ। এ মদীনার কথা এবং তার সাক্ষ্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) পেশ করেছেন। তিনি আরও বলেন, নবী (স) ঈদগাহতেই কুরবানী করতেন।

কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক
কুরআন কুরবানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের প্রতি ইংগিত করে। সত্য কথা এই যে, কুরবানী প্রকৃতপক্ষে তা-ই যা এসব উদ্দেশ্যের অনুভূতিসহ করা হয়।

আরো পড়ুন :

হজ্জ কাকে বলে

হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী

হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত কয়টি

হজ্জের মিকাত কয়টি ও কি কি

ইহরাম কি ও ইহরাম বাধার নিয়ম

বাংলাদেশের মীকাত কি

হজ্জের ফরজ কয়টি ও কি কি

হজ্জ কি প্রত্যেক বছর পালন করতে হবে

হজ্জ কত হিজরীতে ফরজ হয়েছে ?

হজ্জের গুরুত্ব ও ফজিলত

হজ্জে মাবরুর কাকে বলে

ট্যাগ সমূহ : কুরবানির ইতিহাস,কুরবানির ধারণাটি ব্যাখ্যা কর,কুরবানির তাৎপর্য,কুরবানির শিক্ষা ও তাৎপর্য,কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য,কুরবানির আয়াত,কুরবানীর বর্ণনা,মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী,সর্বপ্রথম কুরবানী,কুরবানির ইতিহাস,কুরবানির ধারণাটি ব্যাখ্যা কর,কুরবানির তাৎপর্য,কুরবানির শিক্ষা ও তাৎপর্য,কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য,কুরবানির আয়াত,কুরবানীর বর্ণনা,মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী,সর্বপ্রথম কুরবানী,কুরবানির ইতিহাস,কুরবানির ধারণাটি ব্যাখ্যা কর,কুরবানির তাৎপর্য,কুরবানির শিক্ষা ও তাৎপর্য,কুরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য,কুরবানির আয়াত,কুরবানীর বর্ণনা,মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী,সর্বপ্রথম কুরবানী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top