যাকাত দেওয়ার নিয়ম
আয়হীন গরিব মানুষ, কারাগারে বন্দির পরিবার, ঋণে জর্জরিত লোক, সন্তানহীন বৃদ্ধ ও অথর্ব বয়স্ক নারী-পুরুষ ও আকস্মিক রোগব্যধিতে আক্রান্ত দুঃখী মানুষ আপনার দানের অপেক্ষায়। এদের মধ্যে যারা যাকাত পাওয়ার হকদার তাদেরকে যাকাত দিন। যারা সাধারণ দান পেলে বিপদমুক্ত হয় তাদের দান-সাদাকাহ করুন। পবিত্র রমজানে নফল দান; ফরজের সমান সওয়াব নিয়ে আসবে। আর যাকাতের সওয়াব হবে অন্য সময়ের চেয়ে সত্তর গুণ।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, এতিম ও বিধবার জন্য যে কষ্ট করে জীবিকা অর্জন করে তার মর্যাদা সারাদিন রোজা রাখা ও সারা রাত নামাজে দাঁড়িয়ে কাটানো লোকের সমান। -(আল হাদিস)। মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, আমি (মোহাম্মদ সা.) ও এতিমের লালনকারী জান্নাতে পাশাপাশি থাকব। তিনি ( মোহাম্মদ সা.) তখন হাতের দু’টি আঙ্গুল একসাথে মিলিয়ে দেখান, এভাবে একসাথে থাকব।) -আল হাদিস।
আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দুআ করবেন। আপনার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা তাওবা : ১০৩)। এই আয়াতে আল্লাহপাক সম্পদ পরিশোধিত হওয়ার কথা বলেছেন। আর হাদীস শরীফ থেকে জানা যায় যে, যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ পরিশোধিত হয়। কিভাবে যাকাত দিতে হবে তার নিয়ম বিস্তারিত দেওয়া হলো-
যাকাত দেওয়ার নিয়ম
১. যাকাতে মধ্যম ধরনের মাল দিয়ে দেয়া উচিত। এটা ঠিক নয় যে, যাকাত দাতা সাধারণ মাল যাকাত হিসেবে দিবে এবং এটাও ঠিক নয় যে, যাকাত সংগ্রহকারী সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাল যাকাত হিসেবে নিয়ে নেবে। দাতা আল্লাহর পথে ভালো জিনিস দেবার চেষ্টা করবে এবং আদায়কারী কারো ওপরে বাড়াবাড়ি করবে না।
২. যাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালেই জমা হওয়ার কথা। ইসলামী রাষ্ট্রেরই এ দায়িত্ব যে, সে যাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যবস্থাপনা করবে। যেখানে মুসলমানগণ তাদের অবহেলার কারণে গোলামির জীবন যাপন করছে অর্থাৎ যেখানে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই, সেখানে মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের উদ্যোগে মুসলমানদের বায়তুলমাল কায়েম করবে এবং সেখানে সকল যাকাত জমা করবে।
তারপর সেই বায়তুলমাল থেকে যাকাত নির্দিষ্ট খাতগুলোতে ব্যয় করবে। আর এ ধরনের সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা থেকে যদি মুসলমান বঞ্চিত হয় তাহলে নিজের পক্ষ থেকেই হকদারদের কাছে যাকাত পৌছিয়ে দেবে এবং অবিরাম শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে এবং বাস্তব ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে যাতে করে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া আল্লাহ তায়ালার বহু নির্দেশ ও আইন-কানুন মেনে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়।
৩. বায়তুলমাল থেকে যাকাত হকদার কোনো এক ব্যক্তিকেও দেয়া যায় এবং কোনো সংগঠন বা সংস্থাকেও দেয়া যায় । স্বয়ং এ ধরনের কোনো সংস্থাও কায়েম করা যেতে পারে যা যাকাত ব্যয় করার উপযোগী। যেমন- এতিমখানা, দুঃস্থদের জন্যে বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
৪. যাকাত দেয়ার সময় হকদারকে বা যাকাত গ্রহীতাকে একথা বলার প্রয়োজন নেই যে, এ যাকাত । বরঞ্চ উপহার, বাচ্চাদের জন্যে তোফা এবং ঈদের উপহার বলে দেয়াও জায়েয । এতটুকু যথেষ্ট যে যাকাতদাতা যাকাত দেয়ার নিয়ত করবে।
৫. শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক হিসেবে এবং কর্মচারী বা খাদেমকে বেতন হিসেবে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। তবে বায়তুলমালের পক্ষ থেকে যেসব লোক যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের জন্যে নিযুক্ত থাকে তাদের বেতন যাকাতের টাকা থেকে দেয়া যেতে পারে।
৬. বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে অগ্রিম যাকাত দিয়ে দেয়া জায়েয এবং মাসিক কিস্তিতে দেয়াও জায়েয এ শর্তে যে দাতা সাহেবে নেসাব হবে। যদি কেউ এ আশায় অগ্রিম যাকাত দেয় যে, সে সাহেবে নেসাব হয়ে যাবে তাহলে এমন ব্যক্তির যাকাত হবে না। যে সময়ে সে সাহেবে নেসাব হবে এবং বছর পূর্ণ হবে তখন তাকে আবার যাকাত দিতে হবে।-(বেহেশতী জিওর), এবং হযরত আলী (রা) বলেন, হযরত আব্বাস (রা) অগ্রিম যাকাত দেয়া সম্পর্কে নবীর কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমতি দেন।-(আবু দাউদ ও তিরমিজি)
৭. যাকাত যে আদায় করবে (সংগ্রহ করবে) সে ইচ্ছা করলে যে বস্তুর ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়েছে সে বস্তুও নিতে পারে, যেমন সোনা অথবা পশু এবং ইচ্ছা করলে তার মূল্যও নিতে পারে। উভয় অবস্থায় যাকাত হয়ে যাবে। একথা মনে রাখতে হবে মূল্য আদায় করতে হলে তা যাকাত দেবার সময়ে যে মূল্য হবে তাই আদায় করতে হবে—যে সময়ে যাকাত ওয়াজিব হয়েছে সে সময়ের মূল্য নয়।
যেমন- মনে করুন এক ব্যক্তি ছাগল প্রতিপালন করে। বছর পূর্ণ হবার পর একটি ছাগল তার যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। এখন তার মূল্য ৫০ টাকা। এখন কোনো কারণে যাকাত কয়েক মাস বিলম্বে দেয়া হচ্ছে। আর এ সময়ে সে ছাগলটির মূল্য যদি বেড়ে গিয়ে ৬০ টাকা হয় অথবা কমে গিয়ে ৪০ টাকা হয় তাহলে এ ষাট অথবা চল্লিশ টাকা যাকাত দিতে হবে।
৮. যারা সাময়িকভাবে অথবা স্থায়ীভাবে যাকাতের হকদার যেমন পংগু, রোগী, স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল, গরীব-দুস্থ, মিসকীন, বিধবা, এতিম প্রভৃতি । তাদেরকে সাময়িকভাবেও বায়তুলমাল থেকে সাহায্য দেয়া যেতে পারে এবং স্থায়ীভাবেও তাদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৯. অভাবগ্রস্তদেরকে যাকাত খাত থেকে কর্জে হাসানা দেয়াও জায়েয। বরঞ্চ অভাবগ্রস্তদের অবস্থার উন্নয়নের জন্যে এবং তাদের আপন পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে তাদেরকে কর্জে হাসানা দেয়া অতি উত্তম কাজ।
১০. যেসব আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া জায়েয তাদেরকে দিলে দ্বিগুণ প্রতিদান পাওয়া যাবে। এক যাকাত দেয়ার এবং দ্বিতীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার প্রতিদান বা সওয়াব। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন যাকাত গ্রহণ করতে যদি লজ্জাবোধ করে অথবা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও যাকাত নেয়া খারাপ মনে করে, তাহলে তাদেরকে একথা বলা ঠিক নয় এ যাকাতের টাকা বা বস্তু। কারণ হকদারকে যাকাতের কথা বলে দেয়া শর্ত নয় । উকৃষ্ট উপায় এই যে, কোনো ঈদের পূর্বে অথবা বিয়ে শাদীতে সাহায্য বা উপঢৌকন স্বরূপ অথবা অন্য কোনো প্রকারে যাকাত তাদেরকে পৌছিয়ে দিতে হবে।
১১. যাকাত আদায় হওয়ার জন্যে এটাও শর্ত যে, যাকে যাকাত দেয়া যাবে তাকে যাকাতের মালিক বানাতে হবে এবং যাকাত তার হস্তগত হতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি খানা তৈরী করে হকদারকে খাইয়ে দিলো, তাহলে সে যাকাত সহীহ হবে না। হাঁ, খানা তৈরী করে—তার হাতে দিয়ে তাকে যদি এ এখতিয়ার দেয়া হবে যে, সে তা নিজেও খেতে পারে কিংবা অন্যকে খাওয়াতে অথবা যা খুশী তাই করতে পারে, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে । কোনো সংস্থা বা বায়তুলমালকে যাকাত দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়ে যায়। এভাবে যাকাত সংগ্রহ বা আদায়কারীকে দিয়ে দিলেও মালিক বানাবার শর্ত পূরণ হয়। তারপর বায়তুলমাল অথবা যাকাত আদায়কারীর দায়িত্ব এসে গেল । যাকাত দাতার এ দায়িত্ব নয় যে, হকদারকে পুনরায় মালিক বানিয়ে দেবে।
১২. চাঁদ মাস হিসেবে যাকাত হিসেব করে দিয়ে দেয়া ভালো। তবে এটা জুরুরী নয় । সৌর মাস হিসেবেও যাকাত দেয়া যায়। কোনো বিশেষ মাসে যাকাত দিতে হবে তাও জরুরী নয়। কিন্তু যেহেতু রমযান মাস মুবরাক ও বেশী নেকী করার মাস এবং সওয়াব বেশী গুণে পাওয়া যায়, সে জন্যে এ মাসে যাকাত দেয়া সবচেয়ে ভালো। তাই বলে এমন করা ওয়াজিব নয় । যাকাত আদায়ের এ কোনো শর্তও নয়।
১৩. সাধারণভাবে এটাই ন্যায়সংগত যে, এক অঞ্চলের যাকাত সেই অঞ্চলেই ব্যয় বা বণ্টন করা। কিন্তু অন্য অঞ্চলেও বিশেষ প্রয়োজনে দেয়া যায়। যেমন-বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অন্য এলাকায় বাস করে এবং তারা অভাবগ্রস্ত অথবা অন্য এলাকায় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, এমন অবস্থায় সেসব এলাকায়ও যাকাত পাঠানো যায়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, প্রথম এলাকা বা বস্তির কোনো দুঃস্থ লোক যেন বঞ্চিত না হয়।
১৪. যদি কোনো ব্যক্তি নিজের কোনো আত্মীয়, বন্ধু অথবা যে কোনো লোকের পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দিলে তা হয়ে যাবে। যেমন-স্বামী তার স্ত্রীর গহনা প্রভৃতির যাকাত নিজের কাছ থেকে দিয়ে দিলে স্ত্রীর যাকাত দেয়া হয়ে যাবে। একবার নবী পাক (স)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা) নবীর নিযুক্ত যাকাত আদায়কারী-হযরত ওমর (রা)-কে যাকাত দিলেন না। তাতে নবী (স) বললেন, তার যাকাত আমার দায়িত্ব। বরঞ্চ তার চেয়েও বেশী। ওমর তুমি বুঝ না যে, চাচা পিতার সমতুল্য।-(মুসলিম)
আরো পড়ুন :
যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কি কি
ট্যাগ সমূহ : যাকাত দেওয়ার নিয়ম,যাকাত সম্পর্কে হাদিস,যাকাত দানের মাসায়েল,যাকাতের নিয়ম,যাকাত দেওয়ার নিয়ম কানুন, যাকাত দেওয়ার নিয়ম,যাকাত সম্পর্কে হাদিস,যাকাত দানের মাসায়েল,যাকাতের নিয়ম,যাকাত দেওয়ার নিয়ম কানুন,যাকাত দেওয়ার নিয়ম,যাকাত সম্পর্কে হাদিস,যাকাত দানের মাসায়েল,যাকাতের নিয়ম,যাকাত দেওয়ার নিয়ম কানুন, যাকাত দেওয়ার নিয়ম,যাকাত সম্পর্কে হাদিস,যাকাত দানের মাসায়েল,যাকাতের নিয়ম,যাকাত দেওয়ার নিয়ম কানুন,যাকাত দেওয়ার নিয়ম,যাকাত দেওয়ার নিয়ম,যাকাতের নিয়ম,যাকাতের নিয়ম,যাকাতের নিয়ম,যাকাতে কি ধরনের মাল দেয়া উচিত,যাকাতে কি ধরনের মাল দেয়া উচিত,যাকাতে কি ধরনের মাল দেয়া উচিত,যাকাতে কি ধরনের মাল দেয়া উচিত, |