মুতাজিলাদের পতনের ইতিহাস
ওয়াসিল ইবনে আতা কর্তৃক প্রবর্তিত মুতাযিলা মতবাদ ছিল নিছক বুদ্ধিবৃত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি মতবাদ। এ মতবাদে অহীর চেয়ে মানবীয় জ্ঞান প্রজ্ঞার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়। ইসলামের কতিপয় স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বস্বীকৃত বিষয় সম্পর্কে চরম গোঁড়ামির পরিচয় প্রদান করার ফলে এ সম্প্রদায়টি সার্বিকভাবে মুসলমানদের গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি।
মুতাজিলাদের পতনের কারণ
আব্বাসীয় শাসনামলে মুতাযিলা মতবাদ অনুসারীদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সমকালীন রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও মতবাদ রাজসিংহাসন থেকে গরিবের ভাঙা কুটির পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। বসরা, বাগদাদ, সিরিয়া, মিসর, স্পেন ও উত্তর-আফ্রিকা পর্যন্ত এ মতবাদের বিস্তৃতি ঘটেছিল; কিন্তু তাদের প্রভাব বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। নিম্নে তাদের পতনের মৌলিক কারণগুলো উল্লেখ করা হলো-
১. ঐতিহ্যপ্রিয় মুসলমানদের বিরোধিতা : প্রথম থেকেই নিরঙ্কুশ ইসলাম ও অহীর শিক্ষানুসারী ধর্মতত্ত্ববিদগণ মুতাযিলা মতবাদ মেনে নিতে পারেননি বিধায় তারা তাদের বিরুদ্ধাচরণে রাজপথে নেমে পড়েন। বক্তৃতা, বিবৃতি ও ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে সর্বসাধারণ মুসলমানদের তাঁরা নিজেদের মতে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। এটা ছিল মুতাযিলা মতবাদের দুর্গে চরম আঘাত হানার মতো।
২. বিরুদ্ধবাদীদের ওপর অত্যাচার : খলিফা মামুন এবং তার উত্তরাধিকারীরা মুতাযিলা মতবাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বিধায় তারা এর বিরোধীদের ওপর চরম নির্যাতন চালায়। পরবর্তীতে তাদের এ নির্যাতনই মুতাযিলা সম্প্রদায়ের পতন ত্বরান্বিত করে।
৩. রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব : খলিফা মুতাওয়াক্কিল খেলাফতে আরোহণ করে মুতাযিলাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বহুলাংশে খর্ব করেন এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান থেকে হাত গুটিয়ে নেন। ফলে মুতাযিলাগণ জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। এ সময় মুতাযিলা মতবাদ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
৪. ইমাম আহমদের কারাবরণ : মুতাযিলা মতবাদ সমর্থন না করায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) কারারুদ্ধ হন। এ কারণে জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে তাদের পতনের দিন ত্বরান্বিত হয়ে আসে।
৫. ইখওয়ানুস সাফার আবির্ভাব : মুতাযিলা মতবাদের অবধারিত ফলস্বরূপ সৃষ্ট বিশৃঙ্খল মুহূর্তে একদল যুবক মিলিত হয়ে ইখওয়ানুস সাফা নামে একটি জনকল্যাণকামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এ সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দল ও মাযহাবের মধ্যে বিভেদ দূর করে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ সংগঠনের সদস্যদের সৎ উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ মুসলমানদের দৃষ্টি মুতাযিলা মতবাদ থেকে ফিরিয়ে আনে।
৬. শিয়াদের বিরোধিতা : শিয়ারা কস্মিনকালেও মুতাযিলাদের মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া আব্বাসীয় খলিফাদের সহযোগিতায় মুতাযিলারা শিয়াদের বাঁকা চোখে দেখত। তাই পরবর্তীতে শিয়ারা মুতাযিলাদের শত্রু মনে করে তাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে।
৭. অনৈসলামিক মতবাদে বিশ্বাসের বিরূপ প্রভাব : মুতাযিলাগণ পুনর্জন্মে বিশ্বাস ও কুরআনের নশ্বরতার মতো কয়েকটি অনৈসলামিক মতবাদ সৃষ্টি করে জনমনেসন্দেহ সৃষ্টি করে তাদের থেকে দূরে সরে পড়েছিল।
৮. মুতাফিলাদের অনৈক্য : যুগপরিক্রমায় মুতাযিলা মতবাদের অনুসারীদের ঐক্যে ফাটল ধরে এবং বাগদাদে বিশর আল মুতাসিমের নেতৃত্বে বিকল্প মুতাযিলা দল গঠিত হয়। এ দু’গ্রুপের অনৈক্যই তাদের পড়নের অন্যতম কারণ ছিল।
ওয়াসিল ইবনে আতা প্রবর্তিত মুতাযিলা মতবাদ দীর্ঘ তিনশ বছর অত্যন্ত শক্তিশালী ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদ হিসেবে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত ও খলিফা কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে এ মতবাদ দুর্বল হতে থাকে। সর্বশেষ আবুল হাসান আল আশয়ারীর দলত্যাগ ও আশয়ারী মতবাদের সম্প্রসারণ তার পূর্ণ যবনিকাপাত ঘটায়।
আরো পড়ুন :
মুতাজিলা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মতবাদ
মুতাজিলা সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক মতবাদ
মুতাজিলা সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও ইতিহাস
মুতাজিলা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে
শিয়া সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস
খারেজী সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
খারেজীদের বিভিন্ন দল ও তাদের প্রতিষ্ঠাতাদের নাম
ট্যাগ সমূহ : মুতাজিলাদের পতনের কারণ,মুতাজিলাদের পতনের ইতিহাস,মুতাজিলাদের পতন,মুতাজিলাদের,মুতাজিলাদের পতনের মূল কারণ,মুতাজিলা |