প্রশ্ন: কার্বন ও নাইট্রোজেনের যৌগগুলো কীভাবে বায়ু দূষণের জন্য দায়ী তা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহের উৎস, ক্ষতিকর দূষণ এবং নিয়ন্ত্রণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো-
নাইট্রোজেনের যেসব অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত আছে, তন্মধ্যে নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), নাইট্রিক অক্সাইড (NO) এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (NO2) গুরুত্বপূর্ণ। এদেরকে এক সাথে NOx দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহের উৎস :
১. N2O : বায়ুমণ্ডলে অণুজৈবিক প্রক্রিয়ায় এটি উৎপন্ন হয় এবং এটি প্রায় 0.3PPm ঘনমাত্রায় বিরাজ করে।
২. NO : নাইট্রোজেনের দহন প্রক্রিয়ায় এটিই প্রধান উৎপাদ। কয়লা, তেল প্রভৃতি দহনের ফলে এটি উৎপন্ন হয়। এটি অক্সিজেন দ্বারা মন্থর গতিতে কিন্তু ওজোন দ্বারা দ্রুততার সাথে NO2-তে জারিত হয়। NO-এর বায়ুমণ্ডলীয় ঘনমাত্রা প্রায় 0.1-2PPm।
৩. N2O : বায়ুমণ্ডলে N2O -এর ঘনমাত্রা প্রায় 0.001PPm। অতিবেগুনি রশ্মি শোষণের এটি তীব্র শোষক এবং ফটোরাসায়নিক ধোঁয়াশার প্রধান উপাদান। ট্রপোস্ফিয়ারে এটি ফটোরাসায়নিক বিক্রিয়ার সূত্রপাত করে।
ক্ষতিকর দূষণ : বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ তেমন বিপজ্জনক না হলেও ফটোরাসায়নিক অক্সিডেন্ট গঠনে এদের ভূমিকা খুব ক্ষতিকর প্রভাব বা দূষণ সৃষ্টি করে । নাইট্রোজনের অক্সাইডসমূহ (NO,) বায়ুমণ্ডল, উদ্ভিদ এবং মানুষের স্বাস্থ্যকে তীব্রভাবে তীব্রতর করে।
(ক) উদ্ভিদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব :
(i) NO2-এর উচ্চতর ঘনমাত্রা উদ্ভিদের পাতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় মন্থরতা আনয়ন এবং ক্লোরোসিস তৈরি করে।
(ii) NO2-এর ঘনমাত্রা 100ppm-এ উন্নীত হলে উদ্ভিদের কলার বিভাজন ঘটে, এবং পাতার জৈবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
(খ) মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব :
(i) মানব শরীরে NOx এর তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়া পরিলক্ষিত না হলেও NOx এর দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
(ii) NO (নাইট্রিক অক্সাইড) প্রাণ রাসায়নিকভাবে কম সক্রিয় এবং NO2 থেকে অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত। CO এবং নাইট্রাইটের মতো নাইট্রিক অক্সাইড হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হতে পারে এবং অক্সিজেন পরিবহনে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
(iii) নাইট্রিক অক্সাইড কোষীয় লিপিডকে জারণ করে । এটি কতিপয় এনজাইম সিস্টেমকেও বাধাগ্রস্ত করে।
(v) সিগারেটে সাধারণত 350 – 1500 ppm পর্যন্ত NOx থাকতে পারে। তাই, সিগারেটের ধোঁয়ার প্রভাবে ফুসফুসে বিপজ্জনক রোগের সৃষ্টি করে।
(গ) বস্তুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব :
(i) নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহৃত অনেক রঞ্জককে বিনষ্ট করে।
(ii) নাইট্রোজেন সংবলিত রাসায়নিক সার উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে NO2 এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ওজোনের বিয়োজনে অক্সিজেন উৎপন্ন হওয়ার বিক্রিয়ায় NO2 প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
(iii) বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেনের অক্সাইড থেকে এসিড বৃষ্টির (HNO3) উদ্ভব হয়। এটি ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়ে বিভিন্ন অবকাঠামো বিনষ্টসহ ভূপৃষ্ঠের পানি ও মাটির pH মান হ্রাস করে।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ : জীবাশ্ম জ্বালানির দহনে উদ্ভূত NOx নিঃসরণ হ্রাস করতে হবে এবং বায়ু প্রজ্জ্বলন, অতিরিক্ত প্রজনন কার্যকরী করতে হবে । NO অপসারণের পদ্ধতিসমূহের মধ্যে নাইট্রোজেন অক্সাইডের অনুঘটকীয় বিয়োজন, অনুঘটকীয় বিজারণ এবং কঠিন ও তরল পদার্থ দ্বারা NOx অধিশোষণ ঘটাতে হবে। স্ট্যাক গ্যাসে CH4 -এর বিজারণ দ্বারা NO অধিশোষণ করা যায়। পাওয়ার প্ল্যান্ট কিংবা অন্যান্য স্থির উৎস থেকে নির্গত NOx –এর তাপমাত্রা হ্রাস করে এর সাথে নিষ্ক্রিয় গ্যাস যোগ করে এর গঠন রোধ করা যায়।
বায়ুমণ্ডলে কার্বনের অক্সাইডসমূহের প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর : বায়ুমণ্ডলে কার্বনের অক্সাইডসমূহের মধ্যে CO2 , CO প্রধান। এদের প্রভাব নিম্নে আলোচনা করা হলো :
CO2-এর প্রভাব : উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল হতে CO2 গ্রহণ করে এবং O2ত্যাগ করে। এভাবেই প্রাণিকুলের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু অধিক জনসংখ্যা, জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন- প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল, কয়লা-এর অবাধ ব্যবহারের কারণে এবং বিভিন্ন শিল্পকারখানায় অধিক পরিমাণে CO2 বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে।
বর্তমান হারে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ঘটতে থাকলে আগামী 2030 – 2050 সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলের CO2 এর পরিমাণ দাঁড়াবে (500 – 700) PPm। তার ফলে ভূ-পৃষ্ঠে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে 2 – 5°C। বন ধ্বংসের ফলে CO2 গ্যাস এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। CO2 এর পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কার্বন মনোক্সাইড (CO)এর প্রভাব : CO একটি ক্ষতিকর গ্যাস। উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতে এই গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব ব্যাপক। এর প্রভাবে উদ্ভিদে নাইট্রোজেন আবদ্ধকরণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। বায়ুমণ্ডলীয় বায়ুতে সাধারণত 10 PPm পরিমাণ গ্যাস থাকলে ক্লান্তি, ঘুম ঘুম ভাব, বমি, মাথা ঝিমঝিম প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয় । নিঃশ্বাসের ফলে CO গৃহীত হলে তা ফুসফুসের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহে উপনীত হয়।
কার্বন মনোক্সাইড (CO) রক্তের হিমোগোবিনের দ্রুততার সাথে সুস্থিত জটিল যৌগ গঠন করে। এটি রক্তের হিমোগ্লোবিন হতে অক্সিজেনকে অপসারণ করে তার স্থান দখল করে । কারণ, O2 এর চেয়ে CO-এর প্রতি হিমোগ্লোবিনের আসক্তি অধিকতর প্রায় 200 গুণ। এক্ষেত্রে CO হিমোগ্লোবিনের সাথে কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন জটিল গঠন করে।
HIO2 + CO → COHI + O2
এখানে, HI = হিমোগ্লোবিন
COHI = কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিন জটিল।
রক্তে কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিনের পরিমাণ 5% এ উপনীত হলেই মানুষের দেহে অক্সিজেন পরিবহনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ কারণে কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়া বিশুদ্ধ অক্সিজেন পরিবহন বন্ধ করে পরিপাক বিক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
আরো পড়ুন : বৈশ্বিক উষ্ণায়নে উন্নত দেশসমূহ অধিক দায়ী আলোচনা কর।