আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর ইতিহাস
উমাইয়া শাসনামলে খারেজী ও শিয়া সম্প্রদায়ের এবং আব্বাসীয় শাসনামলে মুতাযিলা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এসব দল মুসলমানদের কাছে ইসলামের সঠিক রূপরেখা পেশ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের আমলে ইমাম আবুল হাসান আল আশয়ারী মুতাযিলা দল ত্যাগ করে বসরার এক মসজিদে নিজস্ব চিন্তাচেতনার ভিত্তিতে এক মাযহাবের সূচনা করেন। উক্ত মাযহাবের অনুসারীরাই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামে পরিচিত। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত রাসূল (স)-এর হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। যেমন—
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, বনি ইসরাঈল সম্প্রদায় ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছে। আর অচিরেই আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, একটি দল ছাড়া সবাই জাহান্নামে যাবে। সাহাবায়ে কেরামগন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! [সা:] ঐ দল কোনটি? জবাবে তিনি বললেন, যে পথে আমি ও আমার সাহাবীগণ রয়েছেন।
অপর বর্ণনায় রয়েছে-অর্থাৎ, তা হলো একটি দল। অপর বর্ণনায় রয়েছে- অর্থাৎ, যারা সুন্নাত ও জামায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত । অতএব এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত রাসূল (স)-এর হাদীস দ্বারা স্বীকৃত । অপর বর্ণনায় রয়েছে, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত কুরআনের আয়াত দ্বারা স্বীকৃত।
প্রিয়নবী (স)-এর ইন্তেকালের কিছুদিন পরই তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী বাস্তবে রূপ লাভ করে। কারণ খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনকালের শেষ দিক হতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক গোলযোগকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দলের উৎপত্তি ও বিভক্তি শুরু হয়। তারা সবাই নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি ও নিজেদের চিন্তাচেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামের মৌলিক আকিদা বিশ্বাসের মধ্যে কিছু মনগড়া মতবাদ প্রবেশ করায়। এ কারণে তারা রাসূল (স) ও সাহাবায়ে কেরামের মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে খারেজী, রাফেযী, কাদারিয়া, শিয়া, মুরজিয়া, জাবারিয়া ইত্যাদি সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য।
ইসলামের এমন ক্রান্তিলগ্নে সত্যপন্থি আলেমগণ মহানবী (স) ও তাঁর সাহাবীগণের মতাদর্শসমূহ পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সংরক্ষণ ও প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এমনকি তাঁরা ভ্রান্তপন্থিদের যুক্তিগুলো পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে খণ্ডন করেন। চার মাযহাবের ইমামগণ, ইমাম তাহাবী, ইমাম শাবী ও ইমাম গাযালীর নাম এ সকল মনীষীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সামান্য কিছু মুসলমান ব্যতীত অধিকাংশ মুসলমানই তাদের সমর্থন করে এবং আজও তাদের অধিকাংশই এ মতের অনুসারী। আর এ সত্যপন্থি আলেমগণই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহপ্রদত্ত ও রাসূল (স) প্রদর্শিত পথ মাত্র একটি। যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- অর্থাৎ, নিশ্চয় এটা আমার প্রদত্ত সরল পথ। সুতরাং তোমরা এ পথের অনুসরণ কর, আর অন্য সকল ভ্রান্তপথ অনুসরণ করো না। অন্যথা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেবে। অতএব এ সত্যপন্থি আলেমগণই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদার মূলনীতি : বাস্তবতার নিরিখে এ কথা সুস্পষ্ট যে, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা অত্যন্ত মযবুত ও শক্তিশালী এবং কুরআন সুন্নাহভিত্তিক। এ আকিদা কতিপয় মূলনীতি ও বিধান অনুযায়ী পরিচালিত। যেমন-
১. তাদের আকিদার মূল উৎস হলো আল্লাহর কিতাব, তাঁর রাসূল (স)-এর সুন্নাত ও সালাফে সালেহীনের ইজমা তথা ঐকমত্য।
২. কুরআন মাজীদে বর্ণিত সবটুকুই মুসলমানের জন্য শরীয়ত ও রাসূল (স)-এর সুন্নাত। এগুলো যথাযথ গ্রহণ করা ওয়াজিব। যদিও তা দ্বারা সাব্যস্ত।
৩. কুরআন, হাদীস ও সালাফে সালেহীন এবং যারা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তাদের থেকে যে কোনো জ্ঞান দলীলভিত্তিক হতে হবে।
৪. দীনের নীতিবিধান সবটাই নবী করীম (স) বর্ণনা করেছেন। সুতরাং দীনের ব্যাপারে মনগড়া এমন ব্যাখ্যা প্রদানের সুযোগ নেই, যা দীনের অংশ।
৫. আল্লাহ ও রাসূল (স)-এর বিধানের সামনে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা। সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা ও কেয়াসে কারো ইচ্ছা, কামনা, ধারণাকৃত কাশফ, কল্পনাকৃত শায়খের কথা, ইমামের কথা এবং অন্যান্য কারো বক্তব্যের মাধ্যমে এতে বৈপরীত্য সৃষ্টি করা যাবে না।
৭. আকিদার ক্ষেত্রে শরয়ী শব্দগুলো ব্যবহার করা ও বিদয়াতি পরিভাষাগুলো ত্যাগ করা আবশ্যক।
৮. নবী করীম (স) নিষ্পাপ, এ কথার স্বীকৃতি দেয়া। উম্মতের সকলে ভ্রষ্টতার ওপর একমত হবে, এ বিশ্বাস থেকে মুক্ত থাকা এবং উম্মতের কেউ কাউকে মাসুম না বলা। আর মুজতাহিদগণের চিন্তাচেতনার পার্থক্যের কারণে কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যায় বৈপরীত্য হতে পারে, এ কথায় বিশ্বাস করা।
৯. সত্যিকার স্বপ্ন সত্য এবং তা নবুয়তের অংশ। মুমিনদের এটা সঠিক এবং কারামত ও সুসংবাদস্বরূপ; তবে তা শরীয়তসম্মত হতে হবে।
১০. দীনে লৌকিকতা ঘৃণিত এবং কল্যাণ ও সত্য উদ্ঘাটনে মতপার্থক্য করা বিধিসম্মত। তবে যেসব ব্যাপারে আলোচনা বা সমালোচনার অনুমতি নেই, সেসব ব্যাপারে আলোচনা করা জায়েয নেই।
১১. কোনো মত প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে অহীর পথ আঁকড়ে ধরা আবশ্যক। বিদয়াতকে বিদয়াত দ্বারা ও কোনো উন্নতাকে উন্নতা দ্বারা প্রতিরোধ না করা।
১২. দীনের ক্ষেত্রে সকল নব আবিষ্কৃত বিষয়ই বিদয়াত আর প্রত্যেক বিদয়াতই ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতিই জাহান্নাম।
১৩. আল্লাহর সিফাত-এর ক্ষেত্রে কোনো প্রকার দৃষ্টান্ত ও আকৃতি ছাড়াই আল্লাহ যা তাঁর নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন অথবা রাসূলুল্লাহ (স) আল্লাহর ব্যাপারে যা নির্ধারণ করেছেন, তা সাব্যস্ত করা এবং আল্লাহর ব্যাপারে ঐসব বিষয় অস্বীকার করা, যা আল্লাহ নিজের ব্যাপারে অস্বীকার করেছেন অথবা রাসূলুল্লাহ (স) যা আল্লাহর ব্যাপারে অস্বীকার করেছেন।
১৪. কোনো প্রকার ব্যাখ্যা ছাড়াই আরশ, কুরসী, জান্নাত, জাহান্নাম, কবরের নেয়ামত ও শাস্তি, পুলসিরাত ও মীযানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা ও ভিত্তি অত্যন্ত স্পষ্ট ও দলীলভিত্তিক। যাতে কোনো প্রকার সংশয় ও সন্দেহের অবকাশ নেই। আর বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়েও তারা মযবুত ও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। অতএব এ দলের পথ ও মত আঁকড়ে ধরা ঈমানের অপরিহার্য দাবি।
আরো পড়ুন :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা
أهل السنة والجماعة -এর পরিচিতি
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বৈশিষ্ট্য
কাদিয়ানীদের আকিদার মূলনীতিসমূহ
ট্যাগ সমূহ : আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর ইতিহাস,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রতিষ্ঠাতা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর ইতিহাস,আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের উৎপত্তি,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদার মূলনীতি,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর ইতিহাস,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রতিষ্ঠাতা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর ইতিহাস,আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের উৎপত্তি,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদার মূলনীতি,আহলে সুন্নাত |