আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা
মহানবী (স)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামের ওপর অন্ধকারের ঘনঘটা নেমে এসেছিল। ঠিক এমনি মুহূর্তে উদ্ভব ঘটে ভ্রান্ত মতবাদ খারেজী, শিয়া ও মুতাযিলা সম্প্রদায়ের। বিরাজমান এ পরিস্থিতিতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের আমলে ইমাম আবুল হাসান আল আশয়ারীর ধর্ম দর্শনের ওপর ভিত্তি করে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত আল্লাহপ্রদত্ত ও রাসূল (স) প্রদর্শিত আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। নিম্নে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদার মূলনীতি সম্পর্কিত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদার মূলনীতি : বাস্তবতার নিরিখে এ কথা সুস্পষ্ট যে, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা অত্যন্ত মযবুত ও শক্তিশালী এবং কুরআন সুন্নাহভিত্তিক। এ আকিদা কতিপয় মূলনীতি ও বিধান অনুযায়ী পরিচালিত। নিম্নে চার ইমামের বক্তব্য ও ব্যাখ্যার আলোকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদার মূলনীতিগুলো সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হলো-
১. আকিদার উৎস বিষয়ক মূলনীতি : আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সর্বোচ্চ ও প্রধান মূলনীতি কুরআন ও সুন্নাহর নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসকে আকিদার একমাত্র মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা। যে কোনো বিষয়ে কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসের সব নির্দেশনা সমানভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস করা। সাহাবীগণ ও তাঁদের অনুসারী তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ীগণকে এ বিষয়ে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা। কুরআন সুন্নাহ অনুধাবনের বিষয়ে তাঁদের মতামতের ওপর নির্ভর করা। কুরআন ও হাদীসে যে বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গূঢ় অর্থ নির্ণয়ের অপচেষ্টা না করে প্রকাশ্য, স্পষ্ট ও সরল অর্থে তা বিশ্বাস করা।
কুরআন ও হাদীসে যে বিষয় উল্লেখ করা হয়নি, সে বিষয়কে আকিদার অন্তর্ভুক্ত না করা এবং সে বিষয়ে বিতর্কে না জড়ানো । ইমাম আবু হানীফা (র) বলেন- আমি কুরআনের ওপর নির্ভর করি। কুরআনে যা পাই না, তার জন্য সুন্নাতে রাসূল (স)-এর ওপর নির্ভর করি। যদি কোনো বিষয়ে কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতে না পাই, তাহলে আমি সাহাবীগণের মতামত ও শিক্ষার ওপর নির্ভর করি, তাঁদের মতামত ও শিক্ষার বাহিরে যাই না।
২. তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতের মূলনীতি : এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মূলনীতি হলো, কুরআন ও সহীহ হাদীসে আল্লাহর নাম ও সিফাতের বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে, তা সরল ও স্বাভাবিক অর্থে বিশ্বাস করা, আল্লাহর কোনো নাম, কর্ম বা বিশেষণকে সৃষ্টির নাম, কর্ম বা বিশেষণের সাথে তুলনা পরিহার করা এবং সাথে সাথে আল্লাহর নাম, কর্ম বা বিশেষণের সরল স্বাভাবিক অর্থের বাইরে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা বর্জন করা।
৩. রিসালাতে বিশ্বাসের মূলনীতি : এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মূলনীতি কুরআন ও হাদীসের সর্বজনীনতায় বিশ্বাস করা। রাসূলুল্লাহ (স)-এর পরে কোনো ব্যক্তির ইসমাত, কাদাসাত বা বিশেষ জ্ঞানে বিশ্বাস না করা। তাঁরা কাশফ, ইলহাম, ইলকা ইত্যাদির অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন এবং এগুলোকে ব্যক্তি মুমিনের জন্য কারামত বা মর্যাদা ও নেয়ামত বলে গণ্য করেন; কিন্তু এগুলোকে আকিদার উৎস হিসেবে বা কুরআন সুন্নাহর ব্যাখ্যার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন না। সাহাবীগণ, নবী-বংশ এবং নেককার লোকদের ভক্তি ও ভালোবাসায় তাঁরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন।
তাঁরা নেককার লোকদেরকে ভালোবাসেন; কিন্তু কারো ভালোবাসায় বাড়াবাড়ি করেন না। তাঁরা সকল মুমিনকে আল্লাহর অলী বলে গণ্য করেন, যার তাকওয়া ও কুরআন সুন্নাতের আনুগত্য যত বেশি, সে তত বেশি কামেল অলী বলে বিশ্বাস করেন। তবে কুরআনুল কারীমে বা হাদীস শরীফে যাঁদের বিষয়ে জান্নাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা ব্যতীত অন্য কাউকে সুনিশ্চিত অলী বলা তো দূরের কথা, সুনিশ্চিত জান্নাতী বলেও সাক্ষ্য দেন না; বরং তাদের বিষয়ে ভালো ধারণা করেন এবং তাদের জান্নাতের আশা করেন।
৪. পাপী মুমিন বিষয়ক মূলনীতি : ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি যে, পাপী মুসলিমের বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তাদের সুনিশ্চিত জাহান্নামী বা জান্নাতী বলেননি; বরং শাস্তি, ক্ষমা বা শাস্তিপূর্বক ক্ষমার পর তাদের জান্নাতের আশা পোষণ করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (র) বলেন- আমরা কোনো মুসলিমকে কোনো পাপের কারণে কাফের বলি না, যদিও তা কবীরা গুনাহ হয়। যতক্ষণ না সে পাপটিকে হালাল বলে বিশ্বাস করে। আমরা পাপের কারণে কোনো মুসলিম থেকে ‘ঈমান’-এর নাম অপসারণ করি না; বরং আমরা তাকে প্রকৃত মুমিন বলে আখ্যায়িত করি, সে কাফের না হয়ে ভিও একজন পাপী মুমিন হতে পারে।
৫. রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক বিষয়ক মূলনীতি : ইসলামের প্রথম দুটি ফেরকা শিয়া ভাই ও খারেজী ফেরকার উদ্ভব ও উন্মেষ ঘটেছিল রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভক্তি ঘটে। বিশেষত খারেজীরা এ বিষয়ে দুটি আকিদার উদ্ভাবন করে। যথা- ১. পাপী ব্যক্তির ইমামতের অবৈধতা ২. পাপী ইমামের অপসারণের আবশ্যকতা। তাদের দাবি ছিল, পাপী ব্যক্তি কাফের, আর কাফের সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমামতি করতে পারে না; বরং মুমিনের জন্য ফরয হলো, এরূপ ইমামের বিরুদ্ধে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের অংশ হিসেবে বিদ্রোহ করবে এবং জেহাদ করে একে অপসারণ করবে।
এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের সব নির্দেশনা গ্রহণ করার মূলনীতির আলোকে সাহাবী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমগণ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তাঁদের মতে, অন্যান্য মুমিনের ন্যায় পাপী শাসকের ক্ষেত্রেও পাপের কারণে তাকে কাফের বলা যায় না, যতক্ষণ না সে সুনিশ্চিত কুফরী বা শিরকে নিপতিত হয়। পাপী শাসক প্রশাসকের পাপ যেমন সমর্থন করা যাবে না, তেমনি তার পাপের কারণে রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখতে হবে। ইমাম আবু হানীফা (র) বলেন- আর সকল নেককার ও বদকার মুমিনের পিছনে সালাত আদায় করা বৈধ।
৬. ঐক্য ও বিভক্তি বিষয়ক মূলনীতি : আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্যতম মূলনীতি হলো ঐক্য ও সংহতি। বিভ্রান্ত দলগুলোর সাথে এ বিষয়ে তাদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আকিদার উৎস এক হওয়ার কারণে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমগণের অভ্যন্তরীণ মতভেদ সীমিত। আর ব্যাখ্যা ও পরিভাষাগত মতভেদ তারা সহজে গ্রহণ করেন এবং এজন্য একে অপরকে বিভ্রান্ত বলে গণ্য করেন না। পক্ষান্তরে বিভ্রান্ত দলগুলোর আকিদার উৎস অনেক হওয়াতে তাদের মধ্যকার বিভক্তিও খুব বেশি।
এছাড়াও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদাসমূহ : এছাড়াও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদাসমূহ নিম্নরূপ-
১. হযরত মুহাম্মদ [সা:] শেষ নবী, তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না।
২. কোনো অন্যায়ের কারণে ইমামকে বরখাস্ত করা যাবে না; বরং তাকে সংশোধনহওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সংশোধন না হলে তবে বরখাস্ত করা যাবে।
৩. যোগ্যতাসম্পন্ন যে কেউ খলিফা হতে পারেন। খেলাফতে নবী পরিবারের কোনো বিশেষত্ব নেই।
৪. হযরত মাহদী কেয়ামতের পূর্বে আগমন করবেন। তিনি ফাতেমা ও আলী (রা)-এর বংশধর হবেন বলে হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে।
৫. আনসার মুহাজির সকল সাহাবীই ন্যায়পরায়ণ।
৬. চার খলিফাই ন্যায়সঙ্গত খলিফা।
৭. সাহাবীগণ সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে।
৮. নবী রাসূলগণ মাসুম। তাঁরা সগীরা বা কবীরা কোনো গুনাহে কলুষিত নন, তবে তাঁদের থেকে উত্তমতার খেলাফ কিছু প্রকাশ পেতে পারে।
৯. কবীরা গুনাহের কারণে কোনো মুসলমানকে ফাসেক বলা যাবে; কিন্তু কাফের বলা যাবে না।
১০. রাসূল (স) সশরীরে মিরাজে গমন করেছেন।
১১. আল্লাহ কারো ওপর সামর্থ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপান না।
১২. কবীরা গুনাহকারী মুমিন তওবা ব্যতীত মারা গেলেও চিরকাল দোয়খে থাকবে না।
১৩. মুজতাহিদ তাঁর ইজতেহাদে ভুল শুদ্ধ উভয় প্রকার সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পারেন।
১৪. বান্দার জন্য যা কল্যাণকর, তা করা আল্লাহ তায়ালার ওপর ওয়াজিব নয় ।
১৫. রাসূল (স) ও পুণ্যবান লোক কেয়ামতের মাঠে সুপারিশ করতে পারবেন।
১৬. সত্য নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি হলো অহী ।
১৭. আল্লাহ তায়ালার গুণাবলি তাঁর অস্তিত্ব থেকে স্বতন্ত্র এবং চিরন্তন। তাঁর গুণাবলি মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
১৮. আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি যে বিশ্বাস করে, সে আস্তিক।
১৯. কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই আল্লাহ তায়ালা বান্দার ভালোমন্দ কাজের বিনিময় দেবেন।
২০. মৃতব্যক্তির শান্তির জন্য দোয়া করা শরীয়তসম্মত। এতে শাস্তি লাঘব হয় এবং আত্মা প্রশান্তি পায়।
২১. কুরআন আল্লাহর সত্তার ন্যায় চিরন্তন ও অবিনশ্বর। তবে লিখন, পঠন ও উচ্চারণ সৃষ্ট।
২২. পরকালে মুমিনগণ আল্লাহকে দেখতে পাবে।
২৩. বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীগণ পরমাণুবাদের সমর্থক। তাই তাঁরা মনে করেন, জগৎ পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল।
২৪. আল্লাহ তায়ালা সকল কর্মের স্রষ্টা। সৃষ্টির ক্ষমতা বান্দার নেই। তবে অর্জন করার ক্ষমতা আছে।
২৫. বদরের যুদ্ধে যোগদানকারী সকল সাহাবীই জান্নাতবাসী।
২৬. আশারায়ে মুবাশশারার প্রতি অশোভন আচরণ করাকে তারা হারাম মনে করেন।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত কুরআন ও হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। আর ৭৩ দলের মধ্যে এ দলটিই সঠিক পথের ওপর রয়েছে। সুতরাং এ দলের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য ও ঈমানী দায়িত্ব।
আরো পড়ুন :
أهل السنة والجماعة -এর পরিচিতি
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বৈশিষ্ট্য
কাদিয়ানীদের আকিদার মূলনীতিসমূহ
ট্যাগ সমূহ : আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা pdf,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা বই,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মূলনীতি,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত,আহলে সুন্নাত,আহলে সুন্নাত ওয়াল,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা pdf,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা বই,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মূলনীতি,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত,আহলে সুন্নাত,আহলে সুন্নাত ওয়াল,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা pdf,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা বই,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মূলনীতি,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত,আহলে সুন্নাত,আহলে সুন্নাত ওয়াল,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা, |